Friday 2 January 2015

রোমাঞ্চ গল্প (মোবাইল ভাঃ): এক ভয়ানক সন্ধ্যা (শিশির বিশ্বাস)


এক ভয়ানক সন্ধ্যা
শিশির বিশ্বাস
বিদেশ বিভূঁইয়ে চমৎকার সন্ধেটা হঠাৎ এমন ভয়ানক হয়ে উঠবে, ভাবতেই পারেনি ওরা। অথচ ক্যাপ্টেনের অনুগ্রহে শুরুটা মন্দ ছিল না। ওরা মানে, করিম আলি আর বরেন বোস, পুরনো আমলের কার্গো সিপ ‘বেসিনফোর্ড’এর সবচেয়ে কম বয়সী দুই সী-ম্যান। অল্প দিন হল চাকরিতে ঢুকেছে। করিমের তবু ইতিমধ্যে বেশ কিছু ভয়েজ হয়ে গেছে। বরেনের তাও নয়। মাস কয়েক আগে ‘বেসিনফোর্ড’ হলদিয়া বন্দরে ভিড়েছিল। সেই সময় অসুস্থ এক সী-ম্যানকে ছেড়ে দিতে হওয়ায় বরেনের জায়গা হয়েছে। বরিশালের বাঙাল করিম আলির সঙ্গে কলকাতার ছেলে বরেনের জমে যেতে এরপর সময় লাগেনি। আসলে ‘বেসিনফোর্ড’ জাহাজে তখন ওরা দু’জনই মাত্র বাঙালি।
বরেনের সেই প্রথম ভয়েজেই দিন কয়েকের জন্য জাহাজ ভিড়েছিল ল্যাটিন আমেরিকার এক বন্দরে। আজ রাতেই ছেড়ে যাবার কথা। এই দিনে জাহাজের সী-ম্যানদের কাজ অন্য সময়ের তুলনায় বেশি। তবু যে ওরা ঘণ্টা তিনেকের ছুটি পেয়ে গিয়েছিল, তা ক্যাপ্টেনের অনুগ্রহে। আসলে ব্যাপার হল দিনের পর দিন সমুদ্রে কাটাবার পর কার্গো সিপ যখন বন্দরে ভেড়ে, সবার মধ্যেই নামার তাড়া পড়ে যায়। কয়েক ঘণ্টার ছুটি নিয়ে শহর ঘুরে আসে। কিন্তু এই দফায় বরেন বা করিম কেউই তেমন আগ্রহ দেখায়নি। আসলে দু’জনের কারও বাড়ির অবস্থা তেমন ভাল নয়। স্বভাবতই পকেটে টান। নামা মানেই তো রেস্তোরায় ভালমন্দ কিছু খাওয়া-দাওয়া। নতুন শহর দেখা, কেনাকাটা। শুধুই খরচ। ইচ্ছে থাকলেও তাই গরজ করেনি। কিন্তু শেষ দিনে অন্য রকম হয়ে গেল ক্যাপ্টেনের জন্য। ক্যাপ্টেন প্রবীণ মানুষ। অনেক দিন আছেন এই জাহাজে। খুঁটিনাটি ব্যাপারেও লক্ষ্য রাখেন। বিকেলের দিকে হঠাৎ দু’জন সামনে পড়ে যেতে বললেন, ‘ওহে ছেলেরা, একমাত্র তোমরাই দেখছি এবার জাহাজ থেকে নামনি। তা যাও না, ঘুরে এস খানিক। ঘণ্টা তিনেক ছুটি করে দিলাম।’
ক্যাপ্টেনের ওই কথায় দুই বঙ্গ-সন্তানের মন ভরে গিয়েছিল। তারপর দেরি না করে বেরিয়ে পড়েছিল। ল্যাটিন আমেরিকার এই বন্দর শহরটা খুব ছোট নয়। খানিক এদিক ওদিক ঘুরে সন্ধেয় এক রেস্তোরায় ঢুকে সবচেয়ে সস্তার দু’কাপ কফির অর্ডার দিয়ে দু’জন আকাশ পাতাল ভাবছিল। হাতে এখনও অনেকটা সময়। হঠাৎ চোখ পড়ল, সামনে রাস্তা দিয়ে ঢং-ঢং শব্দে একটা ট্রাম চলেছে। সামনে ডেসটিনেশন বোর্ডে লেখা ‘এল জার্ডিন’। ওদের জাহাজ ‘বেসিনফোর্ড’ প্রায় মাস দুই হল এদিকের গোটা কয়েক বন্দরে জাহাজ ভিড়িয়েছে। সেই দৌলতে স্থানীয় কিছু কথা বরেন ইতিমধ্যেই রপ্ত করে ফেলেছে। তাই ট্রামের ডেসটিনেশন বোর্ডের দিকে নজর পড়তেই উৎসাহে দু’চোখ নেচে উঠল। স্প্যানিশ ভাষায় জার্ডিন মানে গার্ডেন, অর্থাৎ বাগান। পুরো এল জার্ডিন শব্দের অর্থ ‘দি গার্ডেন। ও পাশে করিমকে বলল, ‘চল, হাতে সময় যখন আছে একবার এল জার্ডিন ঘুরে আসি। ট্রামের ভাড়া কত আর পড়বে!’
বরেনের কথায় গোড়ায় করিমের চোখ দুটো নেচে উঠলেও মুহূর্তে মিইয়ে গেল। এই বন্দরে আগে না এলেও আগের এক ভয়েজে এদিকের অন্য বন্দরে ওদের জাহাজ ভিড়েছিল। তাই অভিজ্ঞতা আছে। বর্তমানে ল্যাটিন আমেরিকার এই দেশগুলোর রাজনৈতিক পরিস্থিতি একেবারেই সুস্থির নয়। গোলমাল লেগেই আছে। এল জার্ডিন’এর কথা সেবার জাহাজেই অন্যদের কাছে শুনেছিল। ও বলল, ‘বাদ দে ভাই। জায়গাটা তেমন ভাল নয়। বিশেষ করে এই সন্ধের পর।’
‘কী যে বলিস!’ ফুঁসে উঠল বরেন। বরাবরই ও একটু জেদি ধরনের। বলল, ‘অমন । চমৎকার নাম। আর তুই বলছিস সন্ধের পর ওখানে ভূতের মজলিশ বসে!’
করিম বরেনের মতো নয়। ঠাণ্ডা প্রকৃতির। হেসে বলল, ‘ভূতের মজলিশের কথা আমি বলিনি।’
‘তাহলে?’ বরেন পালটা চার্জ করল।
করিমের মুখে তৎক্ষণাৎ উত্তর যোগাল না। আসলে ব্যাপারটা বছর খানেক আগে শোনা। এই মুহূর্তে সবটা মনেও নেই। তবু যেটুকু মনে আছে তাই বলতে যাচ্ছিল, হঠাৎ খেয়াল হল টেবিলে কফির কাপ নামিয়ে রেস্তোরার ওয়েটার হাঁ করে ওদের কথা বোঝার চেষ্টা করছে। করিম হেসে বলল, ‘আমাদের বাংলা কথা তুমি বুঝবে না ভাই। আসলে দু’জনের একটু এল জার্ডিনে বেড়াতে যাবার ইচ্ছে। কিন্তু শুনেছি জায়গাটা তেমন ভাল নয়। তাই কি?’
ওয়েটার ছেলেটির বয়স বেশি নয়। আসলে বন্দরের কাছে এসব রেস্তোরার বেশিরভাগ খদ্দেরই নানা দেশের মানুষ। ওয়েটাররা তাই লেখাপড়া তেমন না জানলেও কাজ চালাবার মতো বেশ কয়েকটা ভাষা রপ্ত করে ফেলেছে। দুই ছোকরা খদ্দেরকে নতুন এক ভাষায় কথা বলতে দেখে কৌতূহলে শুনছিল। বাধা পেয়ে চোখ নাচিয়ে বলল, ‘না-না সেনর। অমন ভাল জায়গা এদিকে এখন আর দুটি নেই।’
‘কিন্তু অন্য রকম শুনেছিলাম যে!’ করিম শেষ চেষ্টা করল।
‘সে ছিল এক সময়। পুলিশ আর টেররিস্টদের খণ্ডযুদ্ধ দিনভর গুলির আওয়াজ লেগেই থাকত।’ অল্প মাথা চুলকে ছেলেটি বলল ‘তবে নতুন সরকার আসার পর এখন একদম ঠাণ্ডা। রেডিওয় তো তাই নিয়ে দিনভর প্রচার চলছে। একবার ঘুরে এলেই বুঝতে পারবেন। আর অল্পই তো পথ। পাঁচ মিনিট অন্তর ট্রাম যাচ্ছে।’
কথা মিথ্যে নয়। কাপের কফি শেষ হতে না হতেই ফের একটা ‘এল জার্ডিন’ বোর্ড ঝোলান ট্রাম চলে এল। ওরা রেস্তোরার বিল মিটিয়ে উঠে পড়ল সেটায়।
বড় রাস্তা ছেড়ে ট্রাম একটু পরেই এসে পড়ল নদীর ধার বরাবর অপেক্ষাকৃত সরু রাস্তায়। জানলার ধারে বসে রাতের নদীর দৃশ্য বেশ লাগছিল ওদের। দূরে নদীর মাঝে নোঙ্গর করা আলোয় সাজানো ওদের ‘বেসিনফোর্ড’ জাহাজকেও দেখতে পাওয়া যাচ্ছিল। আরও প্রায় আধ ঘণ্টার মতো চলার পর ট্রাম এক জায়গায় থামতে কন্ডাক্টর ‘এল জার্ডিন টার্মিনাডো’ বলে হেঁকে উঠতে ওরা নেমে পড়ল সেখানে।
যতটা উৎসাহে নেমেছিল, একটু পরে ততটাই নিরাশ হয়ে পড়ল দু’জন। অদূরে মস্ত এক পার্ক। কিন্তু জনমানুষের চিহ্নমাত্র নেই। বাতিগুলোর অবস্থাও ভাল নয়। সাপ্লাই ভোলটেজ কমে যাওয়ায় টিমটিম করে কোনোমতে অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। পথের পাশে বাড়িগুলোতেও আলো নেই। আধো অন্ধকারে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে আছে। পার্কের মূল ফটকের পাশে আধভাঙা অবস্থায় হেলে রয়েছে মস্ত এক নিওন হোর্ডিং। আশপাশে সাইনবোর্ড লাগানো রেস্তোরাঁ, দোকানঘর রয়েছে বটে, তবে ঝাঁপ ফেলা। একটা সাইনবোর্ডে রকমারি খাবারের ট্রে হাতে এক সী-ম্যান পোশাকের ছোকরা খুশিতে নাচ জুড়েছে। সেদিকে তাকিয়ে করিম বলল, ‘আমাদের মতো সী-ম্যানদের জন্য সস্তার কাফে কাম ড্যান্স হল। কিন্তু সবই যে বন্ধ দেখছি! পুরনো দিনের তুলনায় কি আর ফারাক হল!’
মাথা নাড়ল বরেন। চারপাশে প্রায় শ্মশানের নিস্তব্ধতা। কিন্তু তখনও আশা ছাড়েনি। বলল, ‘তবু এসে যখন পড়া গেছে, আর একটু ঘুরে দেখা ভাল। সর্বত্র এমন নাও হতে পারে। একটা সস্তার রেস্তোরাঁ পেলে রাতের খাওয়াটাও সেরে নেওয়া যায়।’
পয়সা খরচা করে এসে এখনই ফিরে যাওয়ার ইচ্ছে করিমেরও ছিল না। বরেনের কথাটা ওর মনে ধরল। এসব ছোট জায়গায় কম পয়সায় চমৎকার অমলেট মেলে। একটাতেই বেশ পেট ভরে যায়। কিন্তু খানিক ঘুরেও দু’জন কোনো ব্যতিক্রম দেখতে পেল না। দোকানপাট সবই বন্ধ। শুনশান পথ। জনপ্রাণীর চিহ্নমাত্র নেই। হঠাৎ পথের পাশে আধো অন্ধকারে কী নড়ে উঠতে বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে করিম প্রায় লাফিয়ে উঠল। দেখে বরেন ভরসা দিয়ে বলল, ‘পুলিশ। এতক্ষণে তবু একটা মানুষের দেখা মিলল! আর পুলিশ যখন, ভাবনার কিছু নেই। কি বলিস?’
ভুল ভাঙতে করিমেরও দেরি হল না। তবে আধো অন্ধকারে পুলিশ পুঙ্গবটির দিকে তাকিয়ে ওর ভুরু কুঁচকে উঠল। খানিক আগে শহরে ঘোরার সময়েও পুলিশ চোখে পড়েছে। কিন্তু মাথায় হেলমেট পরা এমন পুলিশ দেখেনি। বোঝা যায়, লোকটা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে ওদের পর্যবেক্ষণ করছে। আর ওদের পরনে সী-ম্যানের সাদা পোশাক থাকায় লোকটা অনেকক্ষণ আগেই যে ওদের দেখতে পেয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই। ও চারপাশে সন্তর্পণে একবার চোখ ঘোরাল। তারপর চাপা গলায় বরেনকে বলল, ‘পুলিশ শুধু একজন নয় ভাই। পিছনে রাইফেল হাতে আরও বেশ কয়েকজন রয়েছে। এক স্কোয়াডের কম নয়। বরেনভাই কিছু একটা ঘটেছে। মনে হচ্ছে। চল ফিরে যাই।’
কিন্তু কলকাতার ছেলে বরেনকে পুলিশ দেখিয়ে বিশেষ কাবু করা গেল না। ততক্ষণে খানিক দূরে পথের উপর সাইনবোর্ড টাঙানো এক রেস্তোরা তার নজরে পড়ে গেছে। রেস্তোরার আধ ভেজানো সদর দরজা দিয়ে আলোর রেখা রাস্তার উপর এসে পড়েছে। অর্থাৎ খোলা রয়েছে। ও বলল, ‘পুলিশ নিশ্চয় আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে নেই করিমভাই। তাই ও নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। বরং ওদিকে একটা রেস্তোরাঁ খোলা রয়েছে দেখতে পাচ্ছি। গিয়ে কিছু খেয়ে নেওয়া যায়।
করিম বরেনের কথায় আপত্তি করল না। কিন্তু কয়েক মিনিট পরে যথাস্থানে পৌঁছে রেস্তোরাঁর ভেজানো দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকে প্রায় হকচকিয়ে গেল ওরা। রেস্তোরাঁই বটে, কিন্তু এ কী অবস্থা! নোংরা কয়েকদিন ঝাড়পোছ পড়েনি। এক কোনায় গোটা কয়েক ভাঙাচোরা চেয়ার-টেবিল ডাঁই করা। পাশে ভাঙা একটা পিয়ানো। বোধ হয় প্রবল আক্রোশে কেউ কুড়ুল দিয়ে কুপিয়েছে। ব্যতিক্রম, দেয়ালে ঝোলানো যিশুর একটা বড় অয়েল পেন্টিং। এখনও অটুট। ভিতরে কোনো কাস্টমার বা রেস্তোরাঁর কেউ নজরে পড়ল না।
চারপাশে তাকিয়ে প্রমাদ গণল করিম। কিন্তু এই অবস্থায় কী আর করবে? অগত্যা কাছেই এক টেবিলে বসে পড়ল দু’জন। করিম বলল, ‘বরেনভাই আমি হলফ করে বলতে পারি, গত দু'এক দিনের মধ্যে এখানে বড় রকমের কিছু ঝামেলা হয়ে গেছে। চারপাশে দেয়ালের ওই দাগগুলো বুলেটের! বাইরে পুলিশগুলো এখনও ওখানে রয়েছে, তাই না? ওরা আমাদের স্পাই বা টেররিস্ট ঠাওরে বসেনি তো! ল্যাটিন আমেরিকার এসব শহর এই ঝামেলা কিন্তু লেগেই থাকে। আমি ওই জন্যই তখন মানা করেছিলাম।’
ততক্ষণে বিপদের গুরুত্ব বরেনও কিছুটা হৃদয়ংগম হয়েছে। ও জানলার দিকের চেয়ারে বসেছিল। আড়চোখে তাকিয়ে দেখল, করিমের অনুমান মিথ্যে নয়, পুলিশগুলো দূর থেকে ওদের লক্ষ্য করার চেষ্টা করছে। কিন্তু সেটা আর ভাঙল না। ইতিমধ্যে রেস্তোরাঁর কোনো ওয়েটার বা অন্য কারও দেখা মেলেনি। ও দু’বার গলা খাঁকারি দিয়ে টেবিলের ছোট ভিনিগারের বোতলটা বার কয়েক ঠুকল। সেই শব্দে ওদের পিছন দিকে দেয়ালের ওধার থেকে হঠাৎ দুড়দাড় শব্দ। তার একটু পরেই দরজা সামান্য ফাঁক করে এক বয়স্ক মহিলার মুখ। তাকে দেখে করিমের চোখে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফুটল। ও তাড়াতাড়ি বলল, গুড ইভনিং ম্যাম। দুটো ‘অমলেট’ চাই আমাদের। বেশ কড়া করে।’
এদিকে ইংরেজি নয়, সাধারণের ভাষা স্প্যানিশ। করিমের ইংরেজি মহিলা হয়তো নাও বুঝতে পারে। বরেন বলল, ‘ডস ‘তরটিলা’ সেনোরা।’
উত্তরে মহিলা ওদের দিকে কোনোমতে একবার হাত নেড়েই ফের দরজার আড়ালে।
কিন্তু মহিলা সেই যে গেল, আর দেখা নেই। ইতিমধ্যে বরেনের নজর এড়ায়নি, বাইরে একজন পুলিশ সন্তর্পণে ওদের জানলার কাছ দিয়ে বার কয়েক ঘুরে গেছে। লক্ষ্য করছে ওদের। এই অবস্থায় এভাবে বসে থাকা যায় না। ও করিমকে বলল, ‘করিমভাই, চল একবার কিচেনের ওদিকে যাই। মনে হচ্ছে, তাগাদা না লাগালে অমলেট আর আসবে না।’
এভাবে বসে থাকতে করিমেরও ভাল লাগছিল না। বরেনের কথায় সায় দিয়ে উঠে দাঁড়াল। পিছনের সেই ভেজানো দরজা ঠেলে দু’জন ঢুকে পড়ল ওদিকের ঘরে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। তবে ফাঁকা ঘরের ওদিকে হাট করে খোলা আর একটা দরজা। ওরা সেই দরজা দিয়ে ওধারে যেতেই এসে পড়ল সরু এক অন্ধকার প্যাসেজে। বাড়ির সদর দিকের তুলনায় এদিকটা কিছু নিচু। প্যাসেজের ওধারে নামার জন্য কয়েক ধাপ সিঁড়ি। ওরা সন্তর্পণে সেই সিঁড়ি ভেঙে নামতেই পাশাপাশি গোটা কয়েক ঘর। তাদের একটার ভেজানো দরজার ফাঁকে চিলতে আলোর রেখা। ওরা সেই দরজার সামনে এসে বুঝল ভিতরে মানুষ রয়েছে। চাপা গলায় কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। সাথে খুটখুট শব্দ। সেই শব্দে বরেনের মনে হল, সম্ভবত এটাই রেস্তোরার রান্নাঘর। ও বাইরে থেকে বলল, ‘আমরা কাস্টমার। অনেকক্ষণ বসে আছি যে!’
কিন্তু ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। বরেন এবার গলা চড়াল। জোরে নক করল দরজায়। তাতে কাজ হল। ভিতরের গুঞ্জন সামান্য থামল। ওদিক থেকে কেউ স্থানীয় ভাষায় বলল, ‘কে এস?’
সেই কথার অর্থ তেমন বোধগম্য না হলেও করিম আন্দাজে বলল, ‘অমলেট ‘তরটিলা’ দিতে বলেছিলাম তখন। কতক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে আর?’
ঘরের ভিতরে ততক্ষণে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছে। তারপর হঠাৎই খুলে গেল দরজা। করিম আর বরেন বুঝতে পারল, ওদের অনুমানে ভুল হয়েছে। এটা রান্নাঘর নয়। বেশ বড় আকারের ঘরটায় জনা কয়েক মানুষ কাজে ব্যস্ত ছিল। বাইরে অপরিচিত মানুষ দেখে মুহূর্তে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল তাদের মধ্যে। কয়েকজন ঘরের পিছনের দেওয়ালের গরাদ বিহীন জানলা দিয়ে মুহূর্তে উধাও। বাকিরা ছড়িয়ে থাকা কিছু ছাপানো কাগজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একজন ছোট এক প্রেস মেশিনে ছাপার কাজ করছিল। মুহূর্তে কাজ বন্ধ করে জানলা গলে উধাও। ওরা হাঁ করে দেখছে, তার মধ্যেই যে লোকটা দরজা খুলেছিল, হঠাৎ বিবর্ণ মুখে ‘পুলিশিয়া, পুলিশিয়া’ বলে চেঁচিয়ে উঠেই নিমেষে বন্ধ করে দিল দরজা।
বরেন সামনে ছিল। চমকে ঘাড় ফিরিয়ে দেখল, পিছনে সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে উদ্যত রিভলবার হাতে হেলমেট পরা এক পুলিশ অফিসার। ও কী করবে ভাবছে, পিছনে দাঁড়ানো করিম হঠাৎ ‘পালাও’ বলে প্রায় ঊর্ধ্বশ্বাসে সামনের সরু প্যাসেজ ধরে ছুটতে শুরু করল। দেখে বরেনও ছুটল পিছনে।
‘পারার, পারার।’
পিছনে পুলিশ অফিসার উত্তেজিত গলায় চেঁচিয়ে উঠল দু’বার। তারপরেই তার হাতের রিভলবার গর্জে উঠল। তবে অন্ধকারে লক্ষ্যভ্রষ্ট হল। বিপদ ঘনীভূত বুঝে করিম পাশেই একটা দরজা পেয়ে ঠেলে ঢুকে পড়ল ভিতরে। পিছনে বরেন। ঢুকেই বুঝল এটাই রেস্তোরাঁর রান্নাঘর। একটু আগের সেই বয়স্ক মহিলা অবশ্য ওদের দেখেই একটা ফ্রাইপ্যান তুলে তেড়ে এল। ওরা ছুটে ওধারে অন্য একটা দরজা দিয়ে বের হয়ে পড়তেই দেখে, সামনে এক চিলতে ফাঁকা জায়গা। পাশেই ছোট এক পাঁচিল। দেরি না করে দু’জন সেই পাঁচিল টপকে পিছনে এক গলিতে লাফিয়ে পড়ল।
অন্ধকার সরু গলি। ভয়ানক অবস্থা থেকে বের হয়ে দু’জন একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাবে, অন্ধকার কুঁড়ে একটা মানুষ বরেনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। অন্ধকারেও বরেনের বুঝতে পারল পিস্তল হাতে লোকটা পুলিশ। সন্দেহ নেই, বাড়ির পিছনে অন্ধকারে পুলিশটা ওত পেতে ছিল। বাগে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু বরেনও কম নয়। রীতিমতো ব্যায়াম পুষ্ট শরীর। একসময় পাড়ার বক্সিং ক্লাবে নিয়মিত প্র্যাকটিস করত। গোড়ায় একটু ঘাবড়ে গেলেও মুহূর্তে সামলে নিয়ে প্রথমেই পিস্তল সহ পুলিশটার ডান হাতে জম্পেশ দুটো জ্যাব করল। এজন্য পুলিশ পুঙ্গবটি একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। আচমকা আঘাতে তার হাতের অস্ত্র ছিটকে গেল। ততক্ষণে করিমও এগিয়ে এসেছে। তাই পুলিশটার কবজা থেকে বেরিয়ে আসতে বরেনের সময় লাগল না। মুহূর্তে দু’জন সেই অন্ধকার গলিপথ ধরে ছুটতে শুরু করল। পিছনে পুলিশটা তখন ঘন-ঘন বাঁশি বাজাতে শুরু করেছে।
পিস্তলটা কুড়িয়ে নিয়ে পুলিশটা হয়তো গুলি ছুঁড়তে পারে, এই ভয়ে ওরা সেই গলিপথে বেশি না ছুটে পাশে অন্য একটা পথ ধরে একটু পরেই অপেক্ষাকৃত বড় এক রাস্তায় এসে পড়ল। সেই পথ ধরে মিনিট দুই ছুটতেই আচমকা শেষ হয়ে গেল পথটা। সামনে উঁচু পাঁচিল ঘেরা মস্ত এক ফটক। ওরা কী করবে ভাবছে, এমন সময় দূরে একদল পুলিশের ভারি বুটের আওয়াজ।
বাঁশির আওয়াজে চলে এসেছে দলের অন্যরা। করিম বলল, ‘সময় নেই বরেনভাই।। ফটক টপকাতে হবে।’
প্রায় বারো ফুট উঁচু লোহার ফটক। তবে পুরনো পাঁচিলের নানা স্থানেই ক্ষতচিহ্ন। ফটকের মাথায় টিমটিমে বাতির আলোয় পাঁচিলের গায়ে সুবিধা মতো গোটা দুই খাঁজ বেছে নিয়ে ওরা সহজেই পাঁচিলের মাথায় উঠে ওধারে নেমে পড়ল।
ভিতরে সুবিশাল এক চত্বর। স্থানে স্থানে উঁচু ল্যাম্প পোস্ট। তার ম্লান আলোয় ওরা বুঝল জায়গাটা কোল ইয়ার্ড। পাহাড় সমান উঁচু উঁই করা একাধিক কয়লার স্তূপ। মাঝ দিয়ে ট্রলি চলার সরু লাইন। ব্যাপারটা অনুধাবন করে করিম প্রমাদ গণল এবার। ওধারে পুলিশের বুটের আওয়াজ আরও কাছে এসে পড়েছে। ও বরেনকে বলল, ‘এ যে আরও বিপদ হয়ে গেল দেখছি! ঘেরা জায়গায় প্রায় ইঁদুরকলে আটকে পড়ার অবস্থা! অযথা পালাবার চেষ্টা না করে ধরা দিই বরং। সত্যিই তো কোনো দোষ করিনি কেউ। একেবারেই ইনোসেন্ট।’
উত্তরে বরেন অল্প হাসল। খানিক আগে পুলিশটিকে যেভাবে নাস্তানাবুদ করেছে, তাতে তার গায়ের ব্যথা দিন তিনেকের আগে মরবে না। ও বলল, সে তো নিশ্চয়। কিন্তু এখন আর তা মানতে চাইবে না কেউ। ওই সময় গলির ভিতর সিঁড়ির নীচে পুলিশ দেখে ঘাবড়ে গিয়ে ছেলেমানুষের মতো ছুটে পালানো একেবারেই ঠিক হয়নি। এখন ধরা দিলে হাজতের ঘানি নিশ্চিত। বরং যতক্ষণ সম্ভব। চেষ্টা করতে দোষ কি?’
ওদের কথার মাঝেই পাঁচিলের ওধারে এক বাড়ির ছাদে জোরালো কয়েকটা সার্চ লাইট। জ্বলে উঠল। সেই সাথে কয়েকজন পুলিশ চিৎকার করে কিছু বলতে লাগল। তার বিন্দুবিসর্গও ওরা বুঝতে পারল না। সার্চ লাইটের আলো ওদের উপর এসে পড়ার আগেই আড়াল পেতে দু’জন কাছেই এক কয়লার স্তূপের দিকে ছুটল। কিন্তু কাছে পৌঁছোবার আগেই সেই স্তূপের পিছন থেকে নতুন একটা সার্চ লাইট হঠাৎ জ্বলে উঠল। ভাগ্যিস, আলোটা সরাসরি ওদের উপর পড়েনি! ওরা ছুটতে ছুটতেই মস্ত এক লং-জাম্পে নিমেষে সেই কয়লার স্তূপে ঝাঁপিয়ে পড়ল। ঝরঝর করে উপর থেকে একরাশ কয়লা ওদের উপর দিয়ে গড়িয়ে গেল। সেই শব্দে দ্বিতীয় সার্চ লাইটের আলোটা ওরা যেখানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেখানে এসে পড়ল। বরেন প্রমাদ গণল এবার। ওদের গায়ে সী-ম্যানের সাদা পোশাক। সন্দেহ নেই, ধরা পড়বে এবার। ও কয়লার স্তূপের ভিতর যথাসম্ভব আরও সেঁধিয়ে গেল। আলোটা কিন্তু কিছুক্ষণ স্থির হয়ে থেকে শেষ পর্যন্ত সরে গেল অন্য দিকে। ব্যাপারটা কী হল, বরেন বুঝে উঠতে পারল না। ও ফিসফিস করে। করিমকে বলল, ‘করিমভাই, ওরা কি দেখতে পায়নি আমাদের?’
‘কী করে দেখবে? অন্ধকারে করিম অল্প হাসল। ‘জামাকাপড়ের দিকে একবার তাকিয়ে দ্যাখ, কী হাল হয়েছে এখন?’
করিমের কথায় বরেনের হুঁশ হল এতক্ষণে। কয়লার কালিতে দু’জনের সারা শরীর। মাখামাখি। ইউনিফর্মের সাদা রং এখন কাল কুচকুচে। চেনার উপায় নেই। তাই দেখে বরেনও ফিক করে হেসে ফেলল। করিম বলল, ‘শুধু তাই নয়। নতুন যে সার্চ লাইটের আলো এসে পড়ল, সেটা কোনো বাড়ি বা টাওয়ার থেকে নয়। ওধারে নোঙ্গর করা এক বার্জের। হাজার হোক ওরা পুলিশ নয়। তাই অত গরজ নেই।’
‘বার্জ!’ অবাক হল বলল। ‘তার মানে ওদিকে নদী!’
‘একদম।’ উত্তরে করিম ফের অল্প হাসল। সন্দেহ হতে ও ইতিমধ্যেই স্তূপের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেছে। কয়লার স্তূপের ওধারে নদীর জলে ইয়ার্ডের ম্লান আলো প্রতিফলিত হয়ে চিকচিক করছে। তাড়াহুড়োয় গোড়ার দিকে মোটেই খেয়াল হয়নি ব্যাপারটা। সন্দেহ নেই, নদীর ধারে এই কোল ইয়ার্ডে বার্জ থেকে কয়লা খালাস হয়। তারপর চালান যায় অন্যত্র। ও বলল, ‘আমাদের কিন্তু আর দেরি করা চলবে না। যেভাবে ওদিকে পুলিশের সার্চ লাইট ঘুরে চলেছে, ধরা পড়ার আগেই সরে পড়তে হবে। সরে পড়ার একটা উপায়ও খুঁজে পেয়েছি মনে হয়।’
মতলবটা করিম না ভাঙলেও ব্যাপারটা তখন বরেনও বেশ বুঝতে পারছিল। বার্জের সার্চলাইট ইতিমধ্যে নিবে গেছে। ওরা সন্তর্পণে কয়লার স্তূপ পাশ কাটিয়ে ওধারে পৌঁছে অন্ধকারে উঁকি দিয়ে বুঝল, বার্জটা নদীর পাড়ে নোঙ্গর করে থাকলেও সম্ভবত ভাটায় আটকে আছে। করিম হাতে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘জোয়ার কিন্তু শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জল চলে আসবে। বার্জটা জোয়ারের অপেক্ষায় থাকলে ছাড়বে মনে হয়। তার আগেই আমাদের এখান থেকে সরে পড়তে হবে।’
পিছনে ইয়ার্ডের ভিতরে ইতিমধ্যে পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। পুলিশের দল ঢুকে পড়েছে ভিতরে। ওরা অন্ধকারে গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গেল নদীর দিকে। খানিক এগোতেই শুরু হয়ে গেল কাদা। বেশ আঠালো কাদার স্তর। তার উপর দিয়ে গুঁড়ি মেরে চলতে যথেষ্টই সমস্যা হচ্ছিল। তারই মধ্যে কাদায় আটকে বরেনের একপাটি জুতো হারিয়ে গেল। ও পরোয়া করল না। বরং অন্য পায়ের জুতোটাও খুলে বিদায় করে দিল।
আর একটু এগোতেই পায়ের নীচে জল পাওয়া গেল। জোয়ারের ঢেউ আছড়ে এসে পড়ছে। কলকল শব্দে বাড়তে শুরু করেছে। ইতিমধ্যে ওরা দেখে নিয়েছে, কাছে নোঙ্গর করা বার্জ রয়েছে আরও কয়েকটা। তাদের একটায় মানুষজন তেমন নেই বলেই মনে হয়। অন্ধকারে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রয়েছে। ওরা সাবধানে সেই বার্জের কাছে পৌঁছে চমৎকার আড়াল
পেয়ে এই প্রথম স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ছাড়ল। বার্জের একটা ঝুলন্ত দড়ি ধরে শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে বরেন চাপা গলায় বলল, ‘পুলিশ আর বোধ হয় আমাদের টিকি ছুঁতে পারবে না।’
করিম অবশ্য তেমন নিশ্চিন্ত হতে পারছিল না। বলল, ‘এখনই তেমন বলা যায় না বরেনভাই। পুলিশ কোল ইয়ার্ডে খুঁজছে আমাদের। যখন বুঝবে পাখি পালিয়েছে খবর দেবে জল-পুলিশে। সার্চ লাইট জ্বেলে জল পুলিশের লঞ্চ তখন খুঁজতে শুরু করবে আমাদের। বিপদ এখনও কাটেনি।’
‘তার বোধহয় দেরি আছে এখনও।’ বরেন বলল ‘কিন্তু রেস্তোরার ছোকরা খামাখা আমাদের অমন ভোগা দিতে গেল কেন? কী বিপদেই না পড়েছি!
‘বোধ হয় তা নয় বরেনভাই। করিম অল্প হাসল, ‘ছোকরা ভোগা দেয়নি। সামান্য রসিকতা করেছিল সম্ভবত। আমরাই বুঝতে পারিনি।’
‘তার মানে!’ অবাক হল বরেন।
‘দেশে নতুন সরকার হয়েছে। শহরের লোকাল অথরিটি দিন-রাত্তির রেডিওতে প্রচার করে চলেছে, এল জার্ডিন নাকি এখন একদম শান্ত, নিরুপদ্রব। সেটা কেমন ধরনের, ছোকরা তাই নিয়েই রসিকতা করছিল তখন। আমরা হাঁদার দল ধরতে পারিনি। আর আমাদের মতোই হাঁদা এদিকের পুলিশগুলো। সন্দেহ নেই, ওই ঘরের ভিতরে সরকার বিরোধী কিছু মানুষ বেআইনি কাগজপত্র ছাপাচ্ছিল। কোনো সূত্রে খবর পেয়ে পুলিশ ওদেরই ধরতে এসেছিল। কিন্তু শেষে তাড়া করল আমাদের। বেমক্কা বিপদ আর কাকে বলে! তবে আমিও ভাই বরিশালের বাঙাল। হাঁদা পুলিশগুলোর নাকে ঝামা ঘষে এবার ঠিক বেরিয়ে যাব। কি পারবে না?’
করিমের মতলব টের পাচ্ছিল বরেন। ও অন্ধকারে অল্প মাথা নাড়ল।
‘গুড।’ করিম সামান্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল এবার। ‘বেশিক্ষণ কিন্তু দেরি করা যাবে না। সাঁতার দিতে হবে এবার।’
দেরি যে করা যাবে না সেটা বরেনও বুঝতে পারছিল। ওদিকে ছোটমতো একটা লঞ্চ জলের উপর সার্চলাইট ঘোরাতে শুরু করেছে। সম্ভবত জল-পুলিশের। ও তাকিয়ে ছিল সেইদিকে। করিম বলল, ‘জোয়ারে ঢেউ কিন্তু বাড়ছে বরেনভাই। আরও বাড়বে এরপর। পারবে তো?’
উত্তরে বরেন মৃদু হাসল। করিম বরিশালের বাঙাল। নদীর সঙ্গে ঘর। কিন্তু ওর মামাবাড়িও যে বেলুড়। বেড়াতে গেলে কতদিন স্নানের সময় সঙ্গীদের সাথে সাঁতরে গঙ্গা পার হয়ে দক্ষিণেশ্বরে মায়ের দর্শন করে গেছে। কিন্তু সেটা আর ভাঙল না। মৃদু মাথা নাড়ল। ‘চেষ্টা তো করতেই হবে।’
‘গায়ের ধড়াচুড়োগুলো কিন্তু খুলতে হবে এবার। তাতে জল-পুলিশের নজরে পড়ার সম্ভাবনা কম। তার উপর প্রয়োজনে ডুব সাঁতারও দিতে হতে পারে।’
ইতিমধ্যে জলে ধুয়ে ইউনিফর্মের সাদা রং আবার ফিরে এসেছে। করিমের কথায় বরেন দ্রুত ইউনিফর্ম খুলে ফেলল। শুধুমাত্র শর্টসটাই রাখল। করিম নিজের ইউনিফর্ম খুলতে খুলতে বলল, ‘জুতোও খুলতে হবে।’
‘সে আমি আগেই বিদেয় করে ফেলেছি।’ বরেন হাসল।
বার্জের দড়ি ছেড়ে দিয়ে দু’জন জোয়ারের অনুকূলে নিঃশব্দে ভেসে পড়ল এরপর।
ঘণ্টাখানেক পরের কথা। কার্গো শিপ ‘বেসিনফোর্ড’এর ছাড়ার সময় হয়ে এসেছে। পোর্ট পাইলট উঠে পড়েছে জাহাজে। ওদিকে ‘বেসিনফোর্ড’এর ক্যাপ্টেন তখন জাহাজের ফার্স্ট অফিসারকে নিয়ে ডেকের উপর পায়চারি করে চলেছেন আর ঘন ঘন চারপাশে চোখ ঘোরাচ্ছেন। দুই ছোকরা তখনও ফেরেনি। হঠাৎ ফার্স্ট অফিসার জাহাজের গ্যাংওয়ের দিকে তাকিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘নিন স্যর, ছোঁড়া দুটো ফিরেছে এতক্ষণে। কিন্তু! বলতে বলতে তার চোখ দুটো প্রায় বিস্ফারিত হয়ে উঠল। ডেকের কিনারায় সরে গিয়ে ঝুঁকে পড়ে গ্যাংওয়ের দিকে ভাল করে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললেন, ‘ক-কিন্তু দু’জনের পরনে সামান্য শর্টস ছাড়া আর কিছুই যে নেই! মনে হচ্ছে বোট না পেয়ে সাঁতরেই চলে এসেছে!’
উত্তরে মুচকি হেসে ক্যাপ্টেন বললেন, ‘হুম, আর সাঁতরে এসেছে এল জার্ডিনের ওদিক থেকে। একটু আগে দুই ছোকরাকে দূরে জলের উপর এক ঝলকের জন্য দেখতে পেয়েছিলাম। ডুব সাঁতার কেটে আসছিল বলে নিশ্চিন্ত হতে পারিনি।
‘অ্যাঁ!’ ক্যাপ্টেনের কথায় প্রায় আঁতকে উঠলেন ফার্স্ট অফিসার। ‘এই রাতে!’
‘তাতে কী?’ ফের মুচকি হাসলেন ক্যাপ্টেন। ‘বেঙ্গলের এই ছোকরা দু’জন আদতে জলের দেশের মানুষ যে! সম্ভবত ওরা এল জার্ডিনের দিকে বেড়াতে গেছল। ট্রামের ভাড়া বাঁচাতে সাঁতরে ফেরার পথ ধরেছে।’
*বিদেশি গল্পের ছায়া অবলম্বনে।
প্রথম প্রকাশ: ‘কিশোর ভারতী’ মে ২০১৩

No comments:

Post a Comment