শিশির বিশ্বাস
ঠক হল যারা লোক ঠকিয়ে খায়‚ অর্থাৎ প্রতারক। ঠক
আজও যেমন রয়েছে‚ সেকালেও ছিল। আর ছিল
তাদের নিয়ে নানা গল্প। এ–গল্পটা শুনেছিলাম আমার দাদুর কাছে।
চমৎকার গল্প বলতে পারতেন তিনি। অনেক পরে একটি ওড়িয়া লোককথার সঙ্গে গল্পটির কিছু
মিল খুঁজে পেয়েছিলাম। তবে সবটা নয়। তাই মনে হয়‚ দাদু তাঁর বেশিরভাগ গল্পের মতো এটিও নিজের মতো
করে নিয়েছিলেন। যাই হোক‚ এবার গল্পটা শোনো।
গোবরচাঁদ আর গণেশচাঁদ দুই ঠক। নাম
আর পেশায় মিল থাকলেও গোড়ায় অবশ্য চেনা–পরিচয় ছিল না। সেটা
একরকম হঠাৎ বলা যায়। সে এক হাটের দিন। রোজগারের ধান্দায় খালের পাড় ধরে
গোবরচাঁদ চলেছে সেই দিকে। মাথায় বস্তা ভরতি হাবিজাবি গাছের ছাল। ওদিকে গণেশচাঁদও
চলেছে সেই হাটের দিকে খালের অন্য পাড় ধরে। তারও মাথায় মস্ত এক বস্তা। তাতে ভরতি
উনুনের ছাই।
চড়া রোদে দুই ঠক হাঁটছে‚ আর আড়চোখে অন্যের দিকে তাকাচ্ছে। মনে মনে
ভাবছে‚ কীভাবে অন্যজনকে
ঠকাবে। একসময় গণেশচাঁদ খালের ওপারে গোবরচাঁদকে উদ্দেশ্য করে বলল‚ ‘কত্তা‚ হাটে যাচ্ছ বুঝি। তা বস্তায় কী?’
‘আমার বস্তায় বাপু বাজারের সেরা মানের
দারচিনি। গন্ধ পাচ্ছ না?’ বলতে বলতে গোবরচাঁদ বড় একটা
সুগন্ধি নিঃশ্বাস টানল। ‘তা তোমার বস্তায় কী বাপু?’
‘আমার বস্তায়?’ গণেশচাঁদ
দেমাক করে বলল‚ ‘আমার বস্তায় বাপু
চালের গুঁড়ো। সরেস গোবিন্দভোগ। হাটে বেচতে যাচ্ছি।’
‘তা এক কাজ করো না বাপু।’ গোবরচাঁদ জুলজুল করে খালের ওপার থেকে তাকাল। ‘হাট তো
এখনো মেলা দূর। এই রোদে অত পথ ভাঙার দরকার কী? যদি রাজি থাকো
তো আমার দারচিনির বস্তার বদলে তোমার চালের গুঁড়োর বস্তা বদলে নিতে পারো। কেনাবেচার
কাজ এখানেই সেরে ফেলা যায়। হাটে আর কষ্ট করে যেতে হয় না।’
গণেশচাঁদও তো তাই চায়। মাথার বস্তায় তো উনুনের ছাই।
তার বদলে এক বস্তা দারচিনি মানে অনেক টাকার জিনিস। খালে জল বেশি নয়। বস্তা মাথায় জল
পার হয়ে সে সোজা এপারে এসে হাজির। বস্তা বদল হতে দু’জনের কেউই এরপর আর দেরি করেনি। ফের যদি অন্য পক্ষের মত পালটে
যায়‚ সেই ভয়ে যে যার বাড়ির
দিকে দৌড়।
গোবরচাঁদ বাড়িতে এসে মাথার বস্তা নামিয়ে হাঁক পাড়ল‚ ‘গিন্নি আজ বেজায় দাঁও মেরে দিইছি। সেই
গাছের ছালের বদলে এক বস্তা চালের গুঁড়ো বাগিয়ে এনেছি। কদিন ধরে সমানে পিঠের বায়না
হচ্ছিল‚ ছেলেপুলে নিয়ে কত খাবে
খাও এবার।’
ওদিকে অন্য ঠক গণেশচাঁদ বাড়িতে বউয়ের সামনে বস্তা
নামিয়ে হেসে বাঁচে না। বেচারা নতুন বিয়ে করেছে। বলল‚ ‘বউ‚ আর ভাবনা নেই। তোমার জন্য নতুন গয়নার ব্যবস্থা করে ফেলেছি এবার। মেলা
টাকার দাঁও মেরেছি আজ। সেই ছাইয়ে বদলে এক বস্তা দারচিনি!’
বলা বাহুল্য, বউদের মুখনাড়ায় দু’জনের মুখ চুন হতে দেরি হয়নি এরপর।
কদিন পরে চলতি পথে দুই ঠক ফের মুখোমুখি। দেখা হতেই দু’জন কেঁদে ফেলল ভেউভেউ করে।
‘ভাইরে‚ নতুন বউয়ের কাছে এমন বেইজ্জতি! মান রাখা দায় হয়েছে।’
‘ভাইরে‚ আমারও সেই অবস্থা। একটা কিছু না করলে বউ–ছেলেপুলের
কাছে আর মুখ দেখানো যাচ্ছে না।’
‘তাই বলি কী‚’ গোবরচাঁদ বলল‚ ‘এবার থেকে দু’জন মিলে ঠকের কারবার শুরু করি। তাতে
আখেরে দু’জনেরই লাভ হবে।’
গণেশচাঁদ তো মুহূর্তে রাজি। হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল‚ ‘তাহলে কারবার আজ থেকেই শুরু করা যাক।’
সেদিনও হাটবার। মতলব এঁটে দুই ঠক হাজির হল এক
কামারশালায়। ফরমায়েশ দিয়ে জুতসই একটা লোহার কড়া তৈরি করাল। সঙ্গে নিল একটা
ক্যানেস্তারাও। বিকেলে হাট তখন জমে উঠেছে। ঢাঁই–ঢাঁই শব্দে বিকট আওয়াজে
ক্যানেস্তারা পেটাতে পেটাতে দুই ঠক হইহই করে সেই হাটের মাঝে।
‘মহারাজা ঢ্যাঁড়া দিয়েছেন। শোন গো সবাই। এক জরুরি
ঘোষণা।’
রাজ্যে মহারাজার বেজায় প্রতাপ। যেমন রগচটা‚ তেমন মেজাজি
মানুষ। তাঁর নাম শুনে হাটের সবাই তো থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। ‘কী ঘোষণা ভাই?
‘মহারাজ আগামী হপ্তায় যুদ্ধে বের হবেন।
আমাদের পাঠিয়েছেন সেপাই জোগাড়ের জন্য।’ গুরুগম্ভীর স্বরে
জানান দিয়ে গণেশচাঁদ কোঁচড় থেকে এরপর সেই লোহার কড়া বের করল। ‘এই কড়া যার হাতে মানানসই হবে, মহারাজার হুকুমে তাকে পলটনে নাম লেখাতে হবে।’
গণেশচাঁদের মুখের কথা খসতে না খসতেই হাট প্রায় সাফ।
মুহূর্তে যে যেদিকে পারে দৌড়। গ্রামের হাট। সবাই ছা’পোষা মানুষ। বউ–ছেলেপুলে নিয়ে সংসার। কে
যুদ্ধে গিয়ে বেঘোরে প্রাণ খোয়াতে চায়? কিন্তু দুই ঠক ছাড়বে
কেন? ছুটে গিয়ে পাকড়াল এক ধান–চালের ব্যাপারীকে। বেচারা
মালপত্র ফেলে পালাতে পারেনি। গণেশচাঁদ নিমেষে সেই কড়া পরিয়ে ফেলল তার হাতে।
‘বাহ্! এই তো দারুণ মানানসই হয়েছে! শরীলে
তাকত আছে দেখছি। এমন লোকই মহারাজের পলটনে দরকার।’ গণেশচাঁদ
দাবড়ে উঠল‚ ‘তা এবার নাম–ঠিকানা বলে ফেল দেখি‚ পলটনের লিস্টিতে দেগে নেই। খবর্দার‚ মিছে কতা কইবিনি। মহারাজের হুকুমে গর্দান যাবে।’ বলতে
বলতে পকেটে হাত দিল সে।
গোবরচাঁদ ইতিমধ্যে তাকে পিছন থেকে চেপে ধরেছে। পালাবার
উপায় নেই। লোকটা হাউমাউ করে উঠল‚ ‘না রে
ভাই‚ দেখতেই এমন‚ আসলে কলজেয় রক্ত নেই মোটে। বেবাক জল। ঘরের
বউই দু’বেলা পেটায়। গায়ে এক রত্তি শক্তি নেই।’
‘মিছে কতা কওয়ার জায়গা পাওনি?’ ধমকে উঠল গণেশচাঁদ। ‘দিব্যি তো পাল্লা ভরতি ধান
মাপতেছিলে! এক একবারে বিশ সের। দেখিনি ভেবেছ?’
অগত্যা উপায়
নেই দেখে লোকটা এবার অন্য পথ ধরল। ব্যবসায়ী মানুষ। কোন দেবতা কিসে তুষ্ট ভালই
জানে। প্রাণের দায়ে কোমরের গেঁজে থেকে এক খাবলা চকচকে টাকা বের করে বলল‚ ‘দাদা গো আমি নেহাত চালের ব্যাপারী। ঢাল–সড়কি জন্মে ধরিনি। বরং কিছু ধরে দিচ্ছি‚ নিয়ে ক্ষ্যামা দেন।’
শিকার যখন লাইনে এসে গেছে‚ দুই ঠক আর দেরি করল না। ছোঁ মেরে টাকাগুলো
হাতিয়ে নিয়ে ছুটল আর একজনকে পাকড়াতে। হাটের অন্য ব্যাপারীরাও
ইতিমধ্যে একে মালপত্র গুছিয়ে ফর্সা হতে শুরু করেছে। সময় নষ্ট করা যায় না।
সন্ধের আগেই দুই ঠগের ট্যাঁক বোঝাই। রাতে
ঘরে ফিরতে ওদের বউরাও আহ্লাদে আটখানা। এমন স্বামীর জয়গান করেও সুখ।
দিন কয়েক পরে দুই ঠক ফের ধান্দায় বের হয়েছে। ঘুরতে
ঘুরতে এসে হাজির দূরের এক গ্রামে। খোঁজ পেয়েছে‚ সেখানে এক বুড়ির মেলা টাকাপয়সা‚ সোনাদানা। নিজের
মানুষ বলতে তিন কূলে দূর সম্পর্কের এক নাতি। সে কখনো এসে দেখে যায়। একাই থাকে
বুড়ি। খবরটা শুনেই দুই ঠক মতলব করে বুড়ির বাড়ি এসে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। ‘পিসি গো‚ এমন হাল হয়েছে তোমার! হায় হায়!’
থতমত খেয়ে বুড়ি তো হাঁ করে তাকিয়ে আছে। গণেশচাঁদ হাত–পা নেড়ে ব্যক্ত করল‚ ‘পিসি গো‚ আমরা হলাম তোমার আপন মামাতো ভাইয়ের দুই
পুত্তুর। বাবার কাছে তোমার কথা কত শুনেছি। তাই তো খুঁজতে খুঁজতে চলে…।’ বলতে বলতে গলা ধরে এল তার। কথা শেষ না করে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছতে লাগল।’
দেখে গোবরচাঁদ এবার পোঁ ধরল‚ ‘পিসি গো‚ কোলে করে কত আমের আচার খাইয়েছ তুমি। শীতকালে
পিঠে পায়েস। মুখে লেগে আছে এখনো। মনে নেই তোমার?’
‘সব‚ সব মনে আছে রে বাছা। মনে আছে।’ পুরোনো কথা ভেবে বুড়ি
হাত–পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসল এবার। তারপর চোখের জল মুছে বলল‚ ‘তোরা অত দূর থেকে পিসির খোঁজ নিতে এয়েছিস
চাট্টি খেয়ে জিরিয়ে নে আগে। আমি ভাত চাপিয়ে দিচ্ছি।’
কেল্লা প্রায় ফতে। গণেশচাঁদ বলল‚ ‘পিসি গো‚ আসল কথাই তো বলিনি। সামনের হপ্তায় ছেলের
বিয়ে ঠিক হয়েছে। এবার তোমার খোঁজ যখন পেয়েছি‚ আশীর্বাদের দিন যেতেই হবে। নয়তো ছেলের বিয়েই দেব না।’
‘সে হবে বাবারা।’ বেজায়
খুশি হয়ে বুড়ি বলল‚ ‘দূর থেকে এসেছিল‚ তেল দিচ্ছি‚ চানটা সেরে আয় এবার।’ বুড়ি
এরপর সিন্দুক খুলে চমৎকার এক সোনার তেলের বাটি বের করে ওদের হাতে দিয়ে পুকুর থেকে
চান করে আসতে বলল। দু’জন সেই তেলের বাটি নিয়ে ছুটল পুকুরের
দিকে। তারপর চান সেরে ফিরে এসে হাউমাউ চিৎকার। ‘গিসি গো‚ ঘাটে তেলের
বাটি রেখে সবে জলে নেমেছি‚ এক বজ্জাত কাক এসে
বাটিটা নিয়ে উড়ে গেল। ভিজে কাপড়ে দু’জন ছুটে ছুটে হয়রান।
কিন্তু হদিশ পেলাম না। কী লজ্জার কথা বলো দেখি! খেতে বসার মুখ নেই আর। হায়—হায়!’
আসলে সবটাই মিছে কথা। অমন সোনার বাটি দেখে দুইজন আর
লোভ সামলাতে পারেনি। পকেটে ভরে ফেলেছে।
ভেবেছিল‚ বুড়ি হয়তো দু’কথা শোনাবে। কিন্তু
বুড়ি তার ধার দিয়েই গেল না। বরং সান্ত্বনা দিয়ে বলল‚ ‘লজ্জা পাসনি বাছারা। পোড়া কপাল আমারই। নইলে শুভ
কাজের শুরুতেই এমন হবে কেন? তা
ভাবিসনি বাছারা। আজই আমার নাতিকে খবর পাঠাচ্ছি। আমার বদলে সেই গিয়ে আশীর্বাদ করে
আসবে।’
বুড়ির নাতি প্রায় ওদেরই বয়েসি। খবর পেয়ে পরের দিন এসে
পৌঁছুতে বুড়ি সিন্দুক খুলে হীরে মণিমুক্তো বসানো একছড়া হার বের করল। তারপর নাতির
হাতে দিয়ে বলল‚ ‘আমার হয়ে তুই
আশীর্বাদ করে আয়।’
বুড়ির নাতি তেজি এক ঘোড়া নিয়ে এসেছিল। তার পিঠে চেপে
তিনজন রওনা হয়ে পড়ল। অনেক পথ পার হয়ে ঘোড়া এক ভিন গ্রামের পথ ধরেছে‚ দুই ঠক কাঁচুমাচু হয়ে বলল‚ ‘দাদাভাই‚ বেজায় খিদে পেয়েছে গো। এদিকে পকেটে কানাকড়ি
নেই। ওই হারছড়া থেকে একটু সোনা যদি দাও‚ কিছু পেটে দিয়ে প্রাণ বাঁচাই।’
‘আরে সেজন্য সোনার গয়নার দরকার কি?’ বুড়ির নাতি হাসল ওদের কথায়। ‘এদিকে সবাই আমার চেনা।
বললেই ধারে মাল দেবে।’
কথা শেষ করে একটু পরেই সে পথের পাশে এক সরাইখানার
সামনে ঘোড়া দাঁড় করিয়ে ওদের দিকে তাকাল। ‘তবে একটা কথা ভাই। মালিক হয়তো জানতে চাইবে এক না দুই। তা দু’জন যখন খাবে জানিয়ে দেবে দুই। ঠিক আছে?’
পথের ধারে মস্ত সরাইখানা। সামনে খাওয়ার ঘর খদ্দেরের
ভিড়ে সরগরম। সবাই গবগব করে খাবার সাঁটাচ্ছে। জনা কয়েক কর্মচারী তাদের
সামাল দিতে হিমসিম। সেদিকে তাকিয়ে সুড়ুত করে জিবের জল টেনে দুই ঠক ঘাড় নাড়ল।
বুড়ির নাতি এরপর ওদের অপেক্ষা করতে বলে সোজা
সরাইখানার মালিকের ঘরে ঢুকে কানে কানে বলল‚ ‘গুরু‚ তোমার সরাইখানায়
ব্যাগার খাটার জন্য দু’জন জবরদস্ত কাজের মানুষ ধরে এনেছি আজ।’
মালিক বাইরে দুই ঠকের দিকে এক পলক চোখ বুলিয়ে নিয়ে
অল্প ঘাড় নাড়ল। ‘হুম‚ মন্দ নয় দেখছি। তবে এক বছর ব্যাগারের জন্য
কিন্তু বেশি দাম দিতে পারব না।’
‘না গুরু‚’ বুড়ির নাতি ফিসফিস করে বলল‚ ‘ওরা দুই বছরের জন্য ব্যাগার দিতে রাজি
হয়েছে। বিশ্বাস না হয়‚ নিজে গিয়ে
শুধিয়ে দেখ।’
সরাইখানার মালিক এরপর ওদের কাছে এসে বলল‚ ‘এক না দুই?’
দুই ঠক তৎক্ষণাৎ মাথা নেড়ে বলল‚ ‘দুই‚ দুই।’
খুশি হয়ে মালিক এরপর ওদের ভিতরে বসিয়ে ছুটল বুড়ির
নাতির কাছে। ঝনঝন করে মোহর গুনে নিয়ে বুড়ির নাতি এরপর এক ফাঁকে পগার পার।
ওদিকে দুই ঠক তো ভুরিভোজের অপেক্ষায় হাঁ করে বসে আছে।
এমন সময় মালিক এসে বলল‚ ‘সংয়ের মতো বসে না
থেকে এবার কাজে লেগে পড় দেখি।’
শুনে দুই ঠক তো প্রায় খাবি খাওয়ার জোগাড়। আকাশ থেকে
পড়ে বলল‚ ‘কাজে লাগব
মানে? দু’জন সেই থেকে খাওয়ার জন্য বসে
আছি!’
শুনে হোটেলের সবাই তো হেসে খুন। কথা
শোনো দুই উজবুকের!
মালিক ষণ্ডা গোছের মেজাজি মানুষ। সামান্য কর্মচারীর
বেয়দপি সহ্য করার পাত্র নয়। মুহূর্তে বিরাশী সিক্কার রদ্দা দুই ঠগের ঘাড়ে কশিয়ে
দিয়ে বলল‚ ‘হতভাগা‚ দুই বছর ব্যাগার দেবার কড়ার করে এখন
বায়নাক্কা! খাবার সেই রাত দুপুরে। এক সানকি ভাত। সময় নষ্ট না করে দুই চাঁদ এবার
কাজে লাগ দেখি।’
বুড়ির নাতি যে ওদের দুই বছরের জন্য সরাইখানায় বেচে
দিয়ে গেছে‚ দুই ঠকের মালুম হতে
এরপর দেরি হয়নি। বুড়ি আর তার নাতি যে ওদের চাইতেও বড় ঠক‚ ঘুণাক্ষরেও টের
পায়নি কেউ। কিন্তু তখন কপাল চাপড়ানো ছাড়া আর কিছুই যে করার নেই।
দু’বছর ব্যাগার দেবার কথা। কিন্তু দুই মাসেই ওদের যা হাল হল‚ তা কহতব্য নয়।
দিন–রাত্তির গাধার খাটুনি।
পান থেকে চুন খসলেই ষণ্ডা মালিকের রদ্দা। খাবার বলতে সেই রাত দুপুরে এক সানকি
ফেলাছড়া ভাত। তাও পেট ভরে নয়। দু’মাসেই দু’জন শুকিয়ে প্রায় আমসি হবার জোগাড়। লম্বা
চুল–দাড়িতে তেলের অভাবে জট
পড়তে শুরু করেছে। চেনাই মুশকিল। এর মধ্যেই ঘটল এক ব্যাপার। সেদিন দু’জন খাবার ঘরের এঁটোকাঁটা সাফ করছে‚ কোতোয়ালি থেকে উর্দিপরা এক পেয়াদা হঠাৎ সরাইখানার সামনে ঘোড়া থেকে নেমে
মালিকের ঘরে গিয়ে ঢুকল। বাইরে থেকে তাদের কথার দু’এক টুকরো কানে আসতে দুই ঠকের তো
প্রায় নাড়ি ছেড়ে যাবার জোগাড়।
কী ভয়ানক! সেই যে হাটে মহারাজার নাম করে দুইজন ঠকবাজি
করে এসেছিল‚ কীভাবে সেই কথা পৌঁছে
গেছে মহারাজার কানে। খেপে গিয়ে দুই ঠককে ধরে আনার এতেলা পাঠিয়েছেন তিনি। খোদ
মহারাজের আদেশ বলে কথা। পেয়াদা সেই খোঁজে এসেছে সরাইখানায়। ভাগ্যিস‚ অনাহারে দু’জনের
চেহারা একে শুকিয়ে প্রায় কাঁকলাস‚ তায় চুল–দাড়ির জটলা। তাই পাশ দিয়ে গেলেও চিনতে পারেনি।
তারপর পেয়াদা বিদায় নিয়েছে এক সময়। ততক্ষণে খুশিতে দুই
ঠকের প্রায় নবজন্ম। আনন্দে আটখানা। রাত একটু গভীর হতেই দু’জন এরপর গটমটিয়ে মালিকের ঘরে। মালিক তখন
খেরোর খাতায় দিনের হিসেব লিখছিল। মুখ তুলে তাকাতেই একজন বলল‚ ‘হুজুর পেয়াদা যাদের খোঁজে এসেছিল‚ আমরাই সেই দুইজন।’
‘অ্যাঁ!’ কেঁপে গিয়ে
মালিকের হাতের কলম ছিটকে পড়ল খানিক দূরে।
‘আজ্ঞে হ্যাঁ হুজুর। পেয়াদার তাড়া খেয়ে
পালিয়ে আপনার সরাইখানায় এসে উঠেছিলাম। তা দুই মাসে যে হাল করেছেন‚ ভাবছি ধরাই দেব এবার। এই কষ্টের থেকে গর্দান
যাওয়া ঢের ভাল। তবে ঠিক করেছি‚ সেই সাথে আপনাকেও শূলে চড়াবার ব্যবস্থা পাকা করে যাব। তাতে মরেও শান্তি।’
‘ঠ—ঠকবাজি করেছিস তোরা। আমি শূলে চড়তে যাব
কেন?’ বলতে গিয়ে মালিকের গলা কেঁপে গেল।
‘সব জেনে–শুনেও আমাদের
এখানে লুকিয়ে রেখেছেন‚ তাই।
মহারাজ যা মেজাজি মানুষ। সব শুনলে আপনিও কী আর ছাড় পাবেন?’ দুই
ঠকের হাসি গাল ছাপিয়ে কান পর্যন্ত পৌঁছে গেল।
‘না—না‚ তা কেন!’ দুই ঠগের
মুখের দিকে তাকিয়ে মালিক এবার প্রায় হাহাকার করে উঠল। ‘তোরা
বরং এক কাজ কর বাবা। দু’টো ঘোড়ার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি‚ আজ রাতেই রাজ্য ছেড়ে পালা।’
‘কিন্তু দুই বছরের মাইনেটাও যে মিটিয়ে দিতে হবে।’
‘দ—দু’বছর কী বলছিস
বাবা! মাত্র তো দু’মাস কাজ করেছিস।’
‘ফ্যাঁকড়ায় না পড়লে সেই দুই বছরই তো খাটাতে
বাপ। এখন না হয় ফাঁদে পড়ে কাউমাউ।’ গণেশচাঁদ বলল‚ ‘চল রে গোবরা‚ তাহলে কোতোয়ালির দিকেই যাই।’
‘তাই চল ভাই। দু‘মাস ধরে যে হেনস্তা‚ এক চিলতে বাঁচার ইচ্ছে নেই।’ গোবরচাঁদ
ব্যক্ত করল।
‘ন—না‚ না।’ বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে
মালিক ওদের পায়ে উপর প্রায় হুমড়ি খেলে পড়ল।
তারপর? তারপর দুই বছরের মাইনে বাবদ দুই ঠক সরাইখানার মালিকের কাছ থেকে কুড়ি কুড়ি
চল্লিশ মোহর বুঝে নিয়ে দুটো ঘোড়ায় সরাইখানা ছাড়ল সেই রাতেই। তারপর হরেক কৌশল
খাটিয়ে দিন কয়েকের মধ্যে বউ–ছেলে নিয়ে ভিন রাজ্যে। সেই সঙ্গে
নাক–কান মুলে শপথ‚ ঠকবাজি আর নয়। ঘটে
বুদ্ধি যখন আছে‚ সৎপথেও বেশ চালিয়ে নিতে পারবে।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
প্রথম প্রকাশ: শারদীয়া ১৪২৩ ‘সঞ্চিতা’ পত্রিকা।
আপলোড: ২২/৭/২০১৭
Nice
ReplyDeletedarun
ReplyDeleteDarun bhalo
ReplyDeleteDarun
ReplyDelete