Monday 2 January 2017

গল্প (মোবাইল ভার্শন): অবেলায় অচেনা পাহাড় (শিশির বিশ্বাস)


ই অবেলায় তুরা পাহাড় যাইছিস বাবু! কালো দেহাতি লোকটা কাঠকুটোর বড় একটা বোঝা মাথায় পাহাড়ি পথে নামছিল। আমাদের কাছে এসে ভুরু কুঁচকে দাঁড়িয়ে পড়ল হঠাৎ
বছর কয়েক আগের কথা। দুই বন্ধু ছোটনাগপুরের ওদিকে বেড়াতে পিয়েছিলাম। তখন বয়স কম। হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা। হাতে কিছু পয়সা জমলে ছুটি দেখে দুতিন দিনের জন্য কাছেপিঠে কোথাও বেরিয়ে পড়ি। সঙ্গী রুমমেট অতনু। ফিরে আসি নতুন উদ্যমে। সেবার কলেজে রবিবার পেঁচিয়ে টানা চার দিনের ছুটি। হাতেও কিছু পয়সা জমা হয়েছে। সাহস করে একটু দূরেই চলে গিয়েছিলাম। দুটো দিন দেখা হল অনেক। রাতে জঙ্গল সাফারি। দারুণ এক ঝরনা। শেষ দিনে তেমন প্রোগ্রাম নেই। দুপুরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। হাঁটতে হাঁটতে টাউন ছাড়িয়ে গ্রামের পথে। দুপাশে অনুর্বর পাথুরে মাটিতে হালকা সবুজের ছোঁয়া। ঝোপঝাড়। বুনো ফুলের গন্ধ। তারই ফাঁকে ছড়ানো ছেটানো গ্রামের কাঁচা ঘরবাড়ি। মানুষের বসতি। দূরে হালকা জঙ্গলের মাথায় শীতের শেষের মিষ্টি রোদ। তারই মাঝে সবুজে ঘেরা ছোট এক পাহাড়।গোড়ায় ঠিক ছিল পাহাড় পর্যন্তই যাব কিন্তু হঠাৎই পালটে গেল মত। যখন পাহাড়ের কাছে পৌঁছুলাম বিকেল হলেও তেমন ঘন হয়নি। সরু পায়ে চলা পথটা এঁকেবেঁকে উঠে গেছে পাহাড়ের মাথায়। হাতছানি দিয়ে ডাকছে। সঙ্গী অতনু বলল চল সৌম্য এতদূর যখন এলাম পাহাড়টা ঘুরে আসি। বড় জোড় ঘণ্টা খানেক লাগবে। হাতে সময়ও আছে।
ফেব্রুয়ারির বিকেল। বাংলায় শীত বিদায় নিলেও এদিকে এখনো রয়েছে। আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথে চলার শুরুটা বেশ ভালই হয়েছিল। কিন্তু খানিক ওঠার পরে মালুম হল যতটা সহজ ভাবা হয়েছিল তা নয়। স্থানে স্থানে চলার পথ বেজায় সরু। দুদিকে কাঁটা ঝোপ আগাছা। পথও এবড়ো খেবড়ো। দাঁত বের করা পাথর। তার কতক আবার আলগা। ভাল করে খেয়াল না করলে বোঝা যায় না। অজান্তে পা দিয়ে বার কয়েক বেসামাল হতে হয়েছে। কিন্তু কেউ গা করিনি। আসলে যত উঠছিলাম চারপাশ তত মনোরম হয়ে উঠছিল। দূরে ছেড়ে আসা শহরটা বাদ দিলে চারপাশে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। বিকেলের রোদে সোনার বরণ। সবুজের ফাঁকে দেহাতি মানুষের ঘরবাড়ির হাতছানি। অজস্র পাখির কলতান।
মাঝ বয়সী দেহাতি মানুষটা ওই সময় পাহাড়ি পথের আড়াল থেকে সামনে এসে দাঁড়াল। আগেই বলেছি লোকটার মাথায় মস্ত এক কাঠকুটোর বোঝা। বাজারে এই কাঠ জ্বালানি হিসেবে বিক্রি হতে দেখেছি বোঝা যায় সেই কাঠের খোঁজেই পাহাড়ে গিয়েছিল। দিন শেষে ঘরে ফিরছে।
লোকটার সেই কথায় ইতিমধ্যে আমাদের ভুরু কুঁচকে উঠেছে।
 কেন গো!
লোকটা ততক্ষণে মাথার বোঝা নামিয়ে দিয়েছে। হাঁপাচ্ছে হাঁসফাঁস করে। মাথায় বিড়ে করা গামছাটা খুলে মুখের ঘাম মুছে বলল তুরা নতুন মানুষ বাবু। অবেলায় অচেনা পাহাড়ে পথ হারাই ফেললে বিপদে পড়বি।
না রে বাপু। হেসে উড়িয়ে দিলাম দুজন। সন্ধে নামতে এখনো ঢের দেরি। তার অনেক আগেই নেমে আসতে পারব।’লোকটা কিন্তু দমল না। হাতের গামছাটা কাঁধে ফেলে বলল না রে বাবু। পারবি নাই। সামনে খতরনক পথ আছে। ফির জঙ্গলভি। বলিস তো হামি সাথে যাইতে পারি।
লোকটার উদ্দেশ্য এতক্ষণে বোঝা গেল। ভড়কি দিয়ে গাইড হতে চায়। সন্দেহ নেই পাহাড়ে অনেক টুরিস্টবাবু বেড়াতে আসেন। তাদের ঘুরিয়ে নিয়ে আসে এরা। কিছু রোজগার হয়। কিন্তু আমরা কেউ সেই মাপের টুরিস্ট নই। পকেটও ভারি নয়। তবু বললাম কত নেবে?’
লোকটার চোখ দুটো কিছু উজ্জ্বল হয়ে উঠল এবার। আগ্রহে বলল সে দিবেন বাবু। যা মর্জি হোয়।
লোকটার সেই কথায় অবশ্য মোটেই খুশি হলাম না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি ভ্রমণার্থীদের ভালমানুষীর সুযোগ নিয়ে এরা অনেক সময় অযথা ঝামেলায় ফেলে অতনু বলল দরকার নেই বাপু। আমরা নিজেরাই যেতে পারব।
চলতে চলতে লোকটার মতলব নিয়ে খানিক হাসিঠাট্টাও হল দুজনের। চলার মজা তাতে কিছু বাড়ল বইকী! এভাবে মিনিট পনেরো কাটার পর হঠাৎ খেয়াল হল পাহাড়ের অর্ধেকও তখন ওটা হয়নি। অথচ ফেব্রুয়ারি মাসের বিকেল দ্রুত পড়ে আসতে শুরু করেছে। অতনু প্রস্তাব করল সোজা পথে না গিয়ে পাকদণ্ডি ধরার। অনেক তাড়াতাড়ি হবে। প্রস্তাব মন্দ নয়। মূল পথের দুপাশেই একাধিক পায়ে চলার পাকদণ্ডি। সমস্যা একটাই সেই পথের অনেক জায়গায় ঝোপঝাড়। গাছপালার জটলা। তবে আমরা পরোয়া করলাম না। পরনে আঁটসাঁট জিনস। পায়ে স্নিকার। সুবিধামতো এক পাকদণ্ডি দেখে উঠে পড়লাম সেই পথে।
খাড়াই পাকদণ্ডি। কোথাও সত্তর ডিগ্রি মতো। প্রায় নাক বরাবর উঠে গেছে উপর দিকে। এমন পথ ভাঙতে হলে হাতে একটা লাঠি থাকলে সুবিধা হয়। পথের পাশ থেকে দুটো চারা গাছ ভেঙে নেওয়া হল। অল্প সময়ের মধ্যেই দু’জন পৌঁছে গেলাম পাহাড়ের মাথায়। বিকেলের পড়ন্ত রোদে বাতাসে হিমেল আমেজ। দারুণ পরিশ্রমের পর শুধু শরীর নয় জুড়িয়ে গেল চোখ দুটোও।
অতনু তো বলেই ফেলল
 যাই বলিস সৌম্য এবারের টুরে সেরা অভিজ্ঞতা আজ। ভাগ্যিস কী খেয়ালে চলে এসেছিলাম!
অতনু কিছু মাত্র বাড়িয়ে বলেনি। পাহাড়ের মাথার উপর থেকে চারপাশের দৃশ্য বড়ো মনোরম। যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজ আর সবুজ। শেষ বিকেলের নরম রোদে মায়াময়। পরিশ্রান্ত শরীরে দুজন বসে পড়লাম বড় একটা পাথরের উপর। অনেকেই তার উপর নিজেদের নাম খোদাই করে গেছে। অনেকেই যে এখানে আসে বোঝা যায়। অতনুও লাল রঙের ছোট এক পাথরের টুকরো খুঁজে তাই দিয়ে লিখে ফেলল দুজনের নাম আর তারিখ। তারপর গল্প করতে করতে কোথা দিয়ে যে সময় গড়িয়ে গেছে খেয়াল নেই। যখন হুঁশ হল পশ্চিম আকাশে সূর্য তখন দিগন্তের কাছে।
অবশ্য সেজন্য তেমন ব্যস্ত হইনি কেউ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে অতনু বলল হাতে সময় যা রয়েছে পাকদণ্ডি পথ ধরলেই সুবিধা। মিনিট কুড়ির মধ্যেই নেমে যেতে পারব। তারপর পা চালিয়ে চললে অন্ধকার ঘন হবার আগেই টাউন।
অতনু ভুল বলেনি পাহাড়ের গা বরাবর মূল পথে সময় অনেকটাই বেশি লাগবে। উঠবার সময় সেটা টের পেয়েই পাকদণ্ডি ধরেছিলাম। দেরি না করে দুজন এবারো সেই পাকদণ্ডি ধরেই নামতে শুরু করলাম
পাহাড় জুড়ে হালকা–পাতলা জঙ্গল। তারই ভিতর দিয়ে পায়ে চলা উঁচুনিচু পাকদণ্ডি স্থানীয় গ্রামের মানুষ যারা জীবিকার সন্ধানে কাঠ, নয়তো বুনো খরগোশ আর পাখি শিকারের জন্য পাহাড়ে আসে তারাই ব্যবহার করে। তাই পথ সর্বত্র সমান নয়। কোথাও খানিক গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। কোথাও এঁকে-বেঁকে আরও গভীরে। গোড়ায় ভেবেছিলাম ওঠার সময় যখন সমস্যা হয়নি নামার সময়ও হবে না সহজেই পথ চিনে নেমে যেতে পারব।
কিন্তু খানিক চলার পরেই মালুম হল
 ব্যাপারটা তেমন নয়। প্রায় মাকড়শার জালের মতো পাকদণ্ডি পথ চলে গেছে নানা দিকে। ওঠবার সময় লক্ষ্য ছিল পাহাড়ের চুড়ো। সঠিক পথ চিনে নিতে সমস্যা হয়নি। কিন্তু নামার সময় তেমন কিছু নেই। একাধিক পথ নেমে গেছে নীচের দিকে। তার কোনো একটা ধরে নামতে গিয়ে কিছুক্ষণ পরে খেয়াল হয় পথটা ফের উপর দিকে উঠতে শুরু করেছে। ভেবেছিলাম মিনিট কুড়ির মধ্যে নেমে যেতে পারব। কিন্তু এভাবে কিছুক্ষণ চলার পরে টের পেলাম পথ হারিয়ে ফেলেছি।
সন্ধ্যার অন্ধকার ইতিমধ্যে ঘন হতে শুরু করেছে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আধ ঘণ্টারও বেশি দু’জন গোলক ধাঁধায় ঘুরে চলেছি। আলোর যা অবস্থা হাতে সময় বড়জোর মিনিট কুড়ি। তারপরেই নেমে আসবে ঘন অন্ধকার। বনজঙ্গল ভরা অচেনা এই পাহাড়ি পথে সর্বনাশের কিছু বাকি থাকবে না তখন। যা করতে হবে এর মধ্যেই।
পাকদণ্ডী ধরতে গিয়ে মূল পথ হারিয়ে ফেলেছি অনেক আগেই। চারপাশে যথাসম্ভব নজর করেও তার হদিস পাওয়া গেল না। দুজন পরামর্শ করে ঠিক করলাম এই অবস্থায় পাকদণ্ডি ছেড়ে ঝোপঝাড় ভেঙে সোজা নীচের দিকে নেমে গেলে মূল পথ যদি নাও পাওয়া যায় পাহাড়ের নীচে অন্তত পৌঁছে যেতে পারব। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তার কিছুই হল না। একেই অন্ধকারে ভাল নজর চলছিল না। তার উপর পথ ছেড়ে ঝোপঝাড় ভেঙে চলতে গিয়ে বিপদ আরো বাড়ল। গাছপালা ঘন না হলেও বেশির ভাগই কাঁটায় ভরা বাবলা নয়তো অন্য কাঁটা ঝোপ। শুধু জামাকাপড়ই ছিঁড়ল না ছড়ে গেল হাতপাও। তারই মধ্যে অদূরে ঝোপের ভিতর হুড়মুড় করে কী একটা প্রাণী ছুটে পালাল।
এতক্ষণে অন্য এক আতঙ্কও শুরু হল ভিতরে। আসবার সময় দিনের আলো ছিল। বন্য জন্তু বলতে নজরে পড়েছিল ছুটে পালানো গোটা কয়েক বুনো খরগোশ আর বড় একটা শেয়াল। প্রাণীটা সম্ভবত ঝোপের ভিতর বিশ্রাম নিচ্ছিল আমাদের দেখে বেজায় বিরক্ত হয়ে দাঁত খিঁচিয়ে উঠলেও লাঠি হাতে দুই জোয়ান দেখে পিটটান দিয়েছিল। তখন ব্যাপারটা বেশ উপভোগ করেছিলাম। এখন মনে হল প্রাণীটা সত্যিই শেয়াল তো? নাকি দেহাতি নেকড়ে? ভাবতে গিয়ে বুকটা কেঁপে উঠল হঠাৎ। দুদিন আগে গাড়িতে যে জঙ্গল সাফারিতে গিয়েছিলাম সেটা এখান থেকে খুব দূরে নয়। ড্রাইভার সেদিন জঙ্গলে বাঘের কথা শুনিয়েছিলেন এক জোড়া নেকড়ের দেখা মিললেও অবশ্য বাঘের খোঁজ মেলেনি তাই নিয়ে কিছু হাসিঠাট্টাও হয়েছিল। সেই কথা মনে পড়তে মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল।
আতঙ্কে কাঠ হয়ে অতনুর দিকে তাকিয়ে ধরা গলায় বললাম তখন সেই লোকটার কথা না শুনে খুব ভুল হয়েছে রে! এবার কী হবে বলতো?’
ডাকাবুকো অতনুও তখন বেজায় ঘাবড়ে গেছে। পকেট থেকে পেনসিল টর্চটা বের করে সাবধানে পায়ের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে বলল সৌম্য এভাবে হবে না অন্য কিছু ভাবতে হবে।
আমার মাথায় কিন্তু কিছুই ঢুকছে না। ঠোঁট উলটে বললাম হ্যাঁরে অতনু তখন যেটাকে শেয়াল ভেবেছিলাম সেটা অন্য কিছু নয়তো?’
হতে পারে। সাপখোপের বিপদও কিন্তু রয়েছে রে তোকে বলিনি খানিক আগে আমার পায়ের কাছ দিয়ে সড়সড় করে কিছু চলে গেল।  কী হবে বল তো? অতনু হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকাল।ডাকাবুকো অতনুর সেই মুখের দিকে তাকিয়ে আমার তখন কেঁদে ফেলতে বাকি। বেড়াতে এসে এমন বিপদে আগে কখনো পড়িনি। আকাশ পাতাল ভাবছি। হঠাৎ খেয়াল হল দূরে পাহাড়ের নীচে দেহাতি মানুষের গ্রামে বাতি জ্বলছে টিমটিম করেপাহাড়ের নীচে গ্রামের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম অতনুকে বললাম দ্যাখ নীচে গ্রামে আলো জ্বলছে। চেঁচিয়ে ডাকলে শুনতে পাবে না ওরা?’
দূর কম নয়। হয়তো সন্ধে নামতে ঘরে ঘরে রান্নার পাট শুরু হয়েছে। সেই আগুন দূর থেকে প্রায় জোনাকির মতো তবু দুজন চিৎকার করে উঠলাম হে শুনতে পাচ্ছেন কেউ? আমরা পাহাড়ে পথ হারিয়ে ফেলেছি। হে
চিৎকারের সঙ্গে অতনু বুদ্ধি করে হাতের টর্চ জ্বালতে আর নেভাতে লাগল। এভাবে মিনিট পনেরো সমানে চিৎকার করে দুজন যখন প্রায় হতাশ দূরে একটা আলো নড়তে লাগল। খানিক পরে মনে হল আলোটা যেন পাহাড়ের দিকে এগিয়ে আসছে। কিছু ভরসা পেয়ে আমরা আরো জোরে চিৎকার শুরু করলাম একটু পরে ওদিক থেকে আওয়াজ এল হো
সাড়া দিচ্ছে রে! একজন হাতে মশাল নিয়ে এদিকেই আসছে যেন! বলতে বলতে অতনু বার কয়েক কপালে হাত ছোঁয়াল। এরপর কিছুক্ষণ আমরা সমানে চিৎকার করে পালটা সাড়া দিতে লাগলাম। অনুমানে যে ভুল নেই বোঝা গেল খানিক পরেই। আলোটা পাহাড়ের অনেক কাছে এখন। দূর থেকে হলেও বোঝা যাচ্ছে হাতে একটা জ্বলন্ত মশাল নিয়ে কেউ এদিকে আসছে। নতুন উদ্যমে আমরা আরও জোরে চিৎকার করে উঠলাম আমরা পাহাড়ের উপর পথ হারিয়ে ফেলেছি। নামতে পারছি না। বাঁচান।
ওদিক থেকে উত্তর এল হুঁশিয়ার থাক বাবু। হামি আইছি।
ভাগ্যিস অতনুর সঙ্গে টর্চ ছিল। তাই অন্ধকারে আমাদের অবস্থান বুঝতে লোকটার সুবিধা হচ্ছিল। মশালের আলো দেখে বুঝতে পারছিলাম পাহাড়ি পথে দ্রুত উঠে আসছে। হাতে মশালের আলোয় কিছুটা দেখতেও পাচ্ছিলাম তাকে। ঝাঁকড়া চুল নেংটি পরা মিশকালো একটা মানুষ। অতনুর টর্চের আলোয় আমাদের অবস্থান অনুমান করে কিছুক্ষণের মধ্যেই সে আমাদের কাছে পৌঁছে গেল। দেখেই চিনলাম বিকেলের সেই দেহাতি মানুষটা। ওকে দেখে দু’জন যেন প্রাণ ফিরে পেলাম। প্রায় জড়িয়ে ধরলাম তাকে।
লোকটা অভয় দিয়ে বলল আর ডর নাই বাবু। চল আমার সঙ্গে।
অতনু বলল বড্ড উপকার করলে ভাই আজ। মনে থাকবে সারা জীবন। কী যে ভয় পেয়েছিলাম!
লোকটা বলল ই পাহাড়ে গোবাঘ (হায়না) আছে বাবু। খতরনক সাঁপ ভি অবেলায় তুদের পাহাড়ে দেখে তাই চিন্তা হইছিল। আঁধারে পথ হারাইলে নামতে পারবি নাই। তাই কুছু হুঁশিয়র ছিলম তারপর তুদের চিৎকার শুনতে পাইলম
শুধু পাহাড় থেকে নামিয়ে দেওয়া নয় লোকটা অনেকটা পথ এগিয়ে দিল আমাদের। হয়তো টাউনেই পৌঁছে দিত। কিন্তু পথে দু’একজন করে মানুষের দেখা মিলতে আমরাই মানা করলাম। হয়তো সারাদিন খাওয়া হয়নি বেচারার। সন্ধেয় ঘরে ফিরে কিছু মুখে দেবার ফুরসতও মেলেনি। আমাদের চিৎকার শুনে ফের ছুটে এসেছে গলা নামিয়ে অতনুর সঙ্গে সামান্য পরামর্শ করে নিয়ে বললাম আর আসার দরকার নেই ভাই। এবার ফিরে যেতে পারো তুমি। আমরা নিজেরাই চলে যেতে পারব।
অতনু ততক্ষণে পার্স খুলে দুটো দশ টাকার নোট বের করে এগিয়ে দিয়েছে লোকটার দিকে। এটা রাখো ভাই। আজ অনেক করলে আমাদের জন্য।
দেখে লোকটা হঠাৎ হাঁহাঁ করে উঠল নানা বাবু।
লোকটার সেই মুখের দিকে তাকিয়ে গোড়ায় মনে হয়েছিল হয়তো আরও কিছু চায়। আর সত্যি আজ যে উপকার ওর কাছ থেকে পেয়েছি তার দাম অনেক বেশি। কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। হাতে টাকা কমে এসেছে। অতনু তবু আরো দশ টাকার একটা নোট বের করল। দেখে লোকটা পিছিয়ে গেল কয়েক পা। তুরা ভুল বুঝছিস বাবু। উ টাকা হামি লিতে পারব নাই।
কেন গো! এবার অবাক হওয়ার পালা আমাদের। অতনু বলল এ তোমার গাইডের মজুরি। আমরা খুশি হয়ে দিচ্ছি। তুমিই তো বলেছিলে তখন।
সিটো বুলেছিলম লোকটা মুখ কাঁচুমাচু করে সামান্য হাত কচলে বলল তখন অন্য বাত ছিল বাবু। আর অখন তুরা বিপদে পড়েছিলি। হামার কাজটো করিয়েছি খালি। এর জন্য কী মজুরি হোয়? তুরাই বল?’
কালো মানুষটার সেই কথায় দুজন তাকিয়ে রইলাম ফ্যালফ্যাল করে। কোনো কথাই সরল না মুখে।
তাইলে আখুন যাই বাবু। কিছু মনে করিস নাই তুরা। 
অবেলায় অচেনা পাহাড়ের মতোই লোকটা চলে গেল এরপর মিলিয়ে গেল অন্ধকার পথের বাঁকে। নামটাও জানা হল না।
ছবি: সমীর দাশ (সৌজন্য: সন্দেশ)

21/4/2017

7 comments: