তালতলার তিনিই
শিশির বিশ্বাস
ভরসন্ধে। হঠাৎ অন্ধকার ফুঁড়ে বের
হয়ে এল ছেলেটা। লিকলিকে শরীর।গায়ের রং কয়েক পোঁচ
আলকাতরাকেও হার মানায়। এই সন্ধের অন্ধকারে ঠাওর
করা মুশকিল। গোড়ায়
বিরূও বুঝতে পারেনি। কিন্তু অন্ধকারে একরাশ
ঝকঝকে দাঁত হঠাৎ ঝিলিক দিয়ে উঠতে বেজায় ঘাবড়ে গিয়েছিল। অথচ বরাবরই ও ডানপিটে
গোছের। ভয়ডর
কম। আর
সেই কারণে বলতে গেলে বাজি ধরে এই ভরসন্ধেয় এখানে আসা।
গরমের ছুটিতে বিরূ এই প্রথম পিসিদের বাড়ি
বেড়াতে এসেছে। পিসি অনেকবার চিঠি লিখেছে ওনাদের শ্রীকণ্ঠপুরের
বাড়িতে বেড়িয়ে যাবার জন্য। কিন্তু ধাপধাড়া গ্রাম বলে
নানা অছিলায় এড়িয়ে গেছে। কিন্তু এবার আর পারেনি। হঠাৎ
অসুস্থ হয়ে পিসি কলকাতায় ওদের বাড়িতে এসেছিলেন চিকিৎসার কারণে। দিন
কয়েক ছিলেন।ঠিক ছিল‚ পিসেমশাই এসে নিয়ে যাবেন। কিন্তু
হঠাৎ বিষয় সংক্রান্ত কাজে আটকে পড়ায় তিনি আসতে পারেননি। পিসিকে
পৌঁছে দেবার দায়িত্ব তাই বিরূর উপর পড়েছিল।
ভাগ্যিস‚ রাজি হয়েছিল। নইলে পিসিদের বাড়িতে হয়তো
আসাই হত না। বর্ধমানের
দিকে অজয় নদীর কাছে পিসিদের বাড়ি একটু বেয়াড়া জায়গায়। ট্রেন থেকে নেমে বাসে অনেকটা
পথ। তারপরে
ভ্যান রিক্সা। সেও কম নয়। আগে নাকি পায়ে হাঁটা বা
গরুর গাড়ি ছাড়া অন্য উপায় ছিল না। এমন জায়গা বলেই হয়তো
শ্রীকণ্ঠপুরে এখনও শহরের ছোঁয়া তেমন লাগেনি। খোলা আকাশের নীচে
এঁকে-বেঁকে বয়ে চলেছে অজয় নদী। দু’ধারে মাইলের পর মাইল শুধু
চাষের খেত। সবুজের মেলা। সব মিলিয়ে এক অন্য আমেজ। কলকাতার
ছেলে বিরূর এমন অভিজ্ঞতা এই প্রথম। ভেবেছিল পিসিকে পৌঁছে দিয়ে
পরের দিনই ফিরে আসবে। সেখানে আজ নিয়ে সাতদিন।ইচ্ছে আছে‚ আরও দিন কয়েক থাকার। তার
অন্য এক কারণ অবশ্য গৌর। পিসিদের গ্রামেই বাড়ি। আসানসোলে
হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে। গরমের ছুটিতে বাড়ি এসেছে। প্রথম
দিনই আলাপ। গৌরের
হালকা পাতলা চেহারা দেখে বোঝা যায় না। কিন্তু বিরূর মতোই ডানপিটে। বয়সেও
ফারাক নেই। তাই
পরিচয় ঘন হতে বিলম্ব হয়নি।
শহরে থেকে পড়াশুনা করলেও গৌর এই গ্রামেরই
ছেলে। সব
নখদর্পণে। সাঁতার‚ নিমেষে গাছের মগডালে‚ নয়তো মাঠে চরে বেড়ানো ঘোড়ায় চড়া কোনোটাতেই
কমতি নয়। এর
মধ্যে সুইমিং ক্লাবে যাওয়ার দরুন সাঁতারে পটু হলেও অন্য দুটো বিরূর জানা ছিল না। কিন্তু
গৌরের দৌলতে শিখে নিতে দেরি হয়নি। অবশ্য গাছে চড়ায় এখনো
গৌরের সঙ্গে পাল্লা দিতে না পারলেও অন্যটায় ছাড়িয়ে যেতে পেরেছে।
এদিকে চলাফেরার সুবিধার জন্য অনেকেরই ঘোড়া
আছে। আকারে
ছোট হলেও এসব দেশি ঘোড়া ভয়ানক বেয়াড়া। তেমন তালিম নেই। অনেক
সময় মালিককেও মানতে চায় না। আর অচেনা কেউ পিঠে চাপলে
কখন যে তড়াক করে লাফিয়ে উঠে সওয়ার ছিটকে ফেলে দেবে‚ ঠিক নেই। দরকার না থাকলে এই সব ঘোড়া
চরে খাবার জন্য নদীর চরে পোড়ো ঘাস জমিতে ছেড়ে দেওয়া হয়। সামনের
দুটো পা ছোট এক দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকে‚ যাতে
বেশি দূর যেতে না পারে। জোড়া পায়ে লাফিয়ে লাফিয়ে
ঘোড়াগুলো ঘাস খেয়ে বেড়ায়। এই সব ঘোড়ার পিঠে চেপে
খানিক ছুটে আসা গ্রামের ডানপিটে ছেলেদের বেজায় পছন্দের খেলা। বলা
বাহুল্য‚ গৌর একদিন বিরূকেও নিয়ে
গিয়েছিল। অবশ্য
বিপদের কথা ঘুণাক্ষরেও প্রকাশ করেনি। অপেক্ষাকৃত বেশ তাগড়াই
একটা ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে হাতে লাগাম ধরিয়ে দিয়েছিল। তারপর সাবধানে ঘোড়ার পায়ের
বাঁধন খুলে খানিক সরে গিয়ে হাঁক‚ ‘এবার টাগল দে বিরূ।’
টাগল মানে পায়ের গোড়ালি দিয়ে ঘোড়ার পেটে
জম্পেশ গুঁতো। একেই বিরূর ভয়ডর কম। তারপর
ব্যাপারটায় দারুণ মজা হচ্ছিল। গড়ের মাঠে বা দীঘার সৈকতে
ঘোড়ায় চড়েছে। কিন্তু নতুন এই অভিজ্ঞতার মজাই আলাদা। নির্দেশ
পেতেই বিন্দুমাত্র তলিয়ে ভাবেনি। দুই গোড়ালি দিয়ে সিনেমার
কাউবয়ের কায়দায় জম্পেশ এক গুঁতো কশিয়ে দিয়েছে ঘোড়ার পেটে। চিঁহি
চিৎকারে ঘোড়াটা লাফিয়ে উঠল মুহূর্তে। ভাগ্যিস লাগামটা হাতছাড়া
হয়নি। তাই
কোনও মতে সামলাতে পারলেও লাগামের দড়ি সামান্য ঢিলে হতেই ঘোড়া ছুটল ঊর্ধ্বশ্বাসে।
ব্যাপার দেখে গৌর তখন ঘাবড়ে গেছে। মজা
করার জন্য এদিকে চরতে আসা সবচেয়ে বেয়াড়া ঘোড়ার পিঠেই তুলে দিয়েছিল বিরূকে। ভেবেছিল‚ প্রথম লাফেই ছিটকে ফেলবে সওয়ারকে। কিন্তু
তা যখন হল না‚ প্রমাদ গণতে হল। বিরূ
কলকাতার মানুষ। অভ্যাস নেই। ঘোড়া যে ভাবে ছুটছে‚ ঢেলা ভরতি জমিতে পড়ে গেলে বিপদ। ও
পিছনে ছুটতে ছুটতে তারস্বরে চেঁচাতে লাগল‚ ‘বিরূ‚ লাগাম
টেনে শিগগির ঘোড়া থামা। ভয়ানক বেয়াড়া ঘোড়া।’
কিন্তু বিরূ ততক্ষণে সামলে নিয়েছে। এমন
দুর্দান্ত অভিজ্ঞতা আগে কখনও হয়নি। টেক্সাসের প্রান্তরে ও তখন
যেন সত্যিকারের এক কাউবয়। শুধু ল্যাসো আর রাইফেলটাই
নেই। গৌরের
কথায় কান না দিয়ে খানিক চক্কর দিয়ে থামল প্রায় মিনিট কুড়ি পরে।
ঘোড়াটা পাশের গ্রামের রাশেদুল শেখের। দারুণ
মেজাজি আর বেয়াড়া বলে বদনাম। চড়তে গিয়ে গৌর নিজেও বার
কয়েক নাকাল হয়েছে। সেই ঘোড়াকে এভাবে কবজা করতে দেখে গৌর নিজেও
কম অবাক হয়নি। বলা যায় এরপর থেকেই বিরূকে একটু অন্য চোখে
দেখতে শুরু করেছে। তারই ফলশ্রুতি স্বরূপ আজকের এই অভিযান।
গ্রাম থেকে অনেকটাই দূরে এই তালতলার শ্মশান। বহু
পুরোনো। একসময়
নাকি গোটা কয়েক তালগাছ ছিল। তাই ওই নাম। এখন
সে গাছ নেই। তবু
ওই নামেই ডাকে সবাই। সেই সাথে নানা রোমহর্ষক
গল্প। কাছাকাছি
বসতিও নেই। নদীর
ধারে ফাঁকা শুনশান মাঠ। ফলে সেইসব গল্প পল্লবিত
হতে সময় লাগেনি। তাই অনেক বদনাম। আজ কথায় কথায় গৌর হঠাৎ সেই
প্রসঙ্গ তুলেছিল। তারপর জল গড়িয়েছে অনেক দূর। রীতিমতো
বাজি ধরাও হয়ে গেছে। ভর সন্ধেয় বিরূ একা ঘুরে
আসবে তালতলার শ্মশান থেকে। শ্মশানের এক কোণে বড় এক
বুনো নোনা আতার গাছ আছে। সন্ধের পরে বাদুড় আসে সেই
ফল খেতে। কিছু
ফেলেও নষ্ট করে। প্রমাণ স্বরূপ তেমন একটা সদ্য খাওয়া ফল বিরূ
কুড়িয়ে আনতে পারলে গৌর ওকে গুরু মানবে।
বিরূ যে রাজি হয়ে যাবে‚ গৌর ভাবতেই পারেনি। কারণ
সর্তটা সহজ নয়। ভর সন্ধেয় ওখানে পৌঁছেই যে ফিরে আসবে‚ তার উপায় নেই। প্রমাণ স্বরূপ যতক্ষণ না
বাদুড়ে ফেলা আধ খাওয়া নোনা আতা না মিলছে থাকতে হবে। ব্যাপারটা বুঝিয়ে তাই
সাবধানও করেছিল। কিন্তু বিরূকে টলানো যায়নি। যথাসময়েই
হাজির হয়ে গেছে শ্মশানে। জায়গাটা নদীর ওপারে। গৌর
নদী পর্যন্ত এগিয়ে দিলেও পার হয়নি। নড়বড়ে এক বাঁশের সাঁকো পার
হয়ে যথাস্থান আরও মিনিট দশেকের পথ।
সেই পথ পার হয়ে বিরূ এরপর যথাসময়ে পৌঁছে গেছে
শ্মশানে নোনা আতার গাছের কাছে। শুনশান হলেও তেমন ভয়ের
কিছু খুঁজে পায়নি। সন্ধ্যে ইতিমধ্যে ঘন হতে দু’একটা করে বাদুড় উড়ে আসতে শুরু
করেছে ঝাঁকড়া গাছটায়। পাতার ফাঁকে তাদের ঝপটা–ঝাপটির শব্দ। সন্দেহ
নেই‚ ফলের দখল নিয়ে। কিন্তু
মাটিতে ফল পড়ার লক্ষণ নেই। বিরূ হাঁ করে দাঁড়িয়েছিল
তলায়। এর
মধ্যেই অন্ধকার ফুঁড়ে হাজির হল ছেলেটা।
আগেই বলেছি‚ ঘন
অন্ধকারে গোড়ায় তেমন বুঝতে পারেনি ও। কিন্তু অন্ধকারে হঠাৎ যখন
একরাশ ঝকঝকে দাঁত ঝিলিক দিয়ে উঠল‚ একটু
ঘাবড়েই গিয়েছিল। ভূতের
গল্প ওর বেজায় প্রিয়। কিন্তু ব্যাপারটা যে স্রেফ
মিথ্যে‚ তাও জানে। যারা
ভুত দেখেছে বলে দাবি করে‚ বেশ
জানে‚ সেটা
মনের ভুল ছাড়া কিছু নয়। সেই কারণেই গৌরের প্রস্তাব
লুফে নিয়েছিল। তাই সামলে নিতেও সময় লাগেনি। তবু
কেঁপে গিয়েছিল গলা‚ ‘ক–কে!’
‘এজ্ঞে আমি পেঁচো।’
‘পেঁচো! সে আবার কী নাম?’ ততক্ষণে
বেশ সামলে উঠেছে ও। প্রায় ধমকে উঠল।
‘এজ্ঞে‚ নাম তো একটা ছিলই। কিন্তু
সবাই পেঁচো বলত কিনা’ ফের একরাশ দাঁত বের করে হাসল ছেলেটা।
‘কেন‚ কেন?’ ভুরু কুঁচকে উঠল বিরূর।
‘এজ্ঞে‚ সে ওদের দোষ নয়। পেঁচোয় ধরেছিল যে। সেই
রোগে শুকিয়ে শুকিয়ে এমন আমসি হয়ে গেলুম! তারপর…।’ কথা শেষ না করেই ছেলেটা
দাঁত বের করে ফের একগাল হাসল।
‘হাসলি যে বড়ো!’ লোকটার
কথার মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারছিল না বিরূ। কলকাতার ছেলে। পেঁচো
যে কোনও রোগের নাম জানা ছিল না। তারপর হঠাৎ ওইভাবে হেসে
ওঠার কারণও বুঝে উঠতে পারেনি।
বিরূর কথায় ছেলেটা কিন্তু দমল না। ‘এজ্ঞে‚ পেঁচোয়
ধরে শরীরের যা হাল হয়েছিল‚ দেখলেই
সবার হাসি পেত যে। সত্যি বলতে কী‚ আমি নিজেও হেসে ফেলেছিলুম একদিন।’
ছেলেটার কথার মাথামুণ্ডু বিশেষ বুঝে উঠতে
পারছিল না বিরূ। তবে তা নিয়ে মাথা ঘামাল না। সামান্য
হেসে বলল‚ ‘তা ভালই হল ভাই। এই
অন্ধকারে কতক্ষণ যে থাকতে হবে‚ ঠিক
নেই। অন্তত
কথা বলার একটা মানুষ পাওয়া গেল।’
‘ভাল কতা কইলেন গো কত্তা। হেঁ–হেঁ। বলি‚ ঘটে আপনার ঘিলু আচে বলে তো মনে হয় না!’
সেই কথায় বিরূর ব্রহ্মতালু পর্যন্ত জ্বলে গেল। ক্লাসে
ফার্স্ট বা সেকেন্ড কখনও হতে পারেনি ঠিকই। তাই বলে মাথায় ঘিলু নেই‚ এমন অপবাদ কেউ দেয়নি। কিন্তু
রাগল না। সেই
সন্ধে থেকে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বাদুড়ের আধ খাওয়া নোনা আতা
কখন মিলবে ঠিক নেই। ততক্ষণ ছেলেটার সঙ্গে কথা
বলে অন্তত সময়টা কাটানো যাবে। মাথা নেড়ে বলল‚ ‘কী জানি ভাই। হতেও পারে। এদিকে
নতুন কিনা। সবকিছু
জানা হয়ে ওঠেনি।’
‘সে তো বুঝতেই পারছি।’ ওদিক থেকে ফের দেঁতো হাসি।
কিন্তু গা করল না বিরূ। বলল‚ ‘তা এই অন্ধকারে এদিকে কী কাজে এসেছ‚ বলো দেখি?’
‘কাজ!’ প্রায়
আকাশ থেকে পড়ল ছেলেটা। ‘আমি নিজের ইচ্ছেয় এসেছি নাকি!
চ্যাংদোলা করে সবাই এনে রেখে গেল যে! সেই থেকে এখেনেই তো আস্তানা।’
‘এ–এখানে!’ এই
প্রথম হোঁচট খেল বিরূ‚ ‘ক–কোথায়? কোনো
ঘর–টর তো
দেখছি না!’
খ্যাক–খ্যাক করে বেজায় হাসি। ‘বেড়ে বলেছেন যা হোক। ঘিলু তো ছার‚ আপনার মাথায় আধখানা ঘুঁটেও নেই দেখছি! গাঁয়ের
শ্মশানে ঘর পাবেন কোতায়!’
‘ত–তাহলে?’ হঠাৎ
ওই কথায় গলাটা ভালই কাঁপল বিরূর। ‘তাহলে থাকা হয় কোথায়?’
‘কেন? ওই
বেলগাছে! যাই বলেন বেড়ে আস্তানা বটে।’ অদূরে মস্ত বেলগাছের দিকে
আঙুল তুলল অন্য পক্ষ।
‘অ্যাঁ! বেলগাছে?’ হঠাৎ
গৌরের কথা মনে পড়ে গেল বিরূর। তালতলার শ্মশানে এই বেলগাছ
নিয়ে এক ভয়ানক গল্প শুনিয়েছিল ও! একেবারেই বিশ্বাস হয়নি তখন। কোন এক তান্ত্রিক সাধু
নাকি বহুদিন আগে এই শ্মশানে ঠাঁই নিয়েছিলেন। রাতে নানা ক্রিয়াকলাপ
করতেন। এক
সকালে দেখা যায় তিনি ঘাড় মটকে মরে পড়ে আছেন। সেই থেকে নানা গুজব। কেউ
বলেন অপঘাতে মরে সেই তান্ত্রিক নাকি ব্রহ্মদৈত্য হয়ে বেলগাছে ঠাঁই নিয়েছেন। অনেকেই
দেখেছে তাঁকে। সেই থেকে রাতে কেউ আর এই শ্মশানে পোড়াতে আসে
না।
সেই কথা মনে পড়তে বিরূর মাথাটা হঠাৎ কেমন
টালমাটাল হয়ে উঠল। বরাবরই ডানপিটে গোছের। এসবে
একেবারেই বিশ্বাস নেই। গৌরের কথায় তাই রাজি হতে
সময় লাগেনি। ছেলেটার
উলটো পালটা কথাও তাই গ্রাহ্য করেনি।
‘কী ভাবতেছেন গো? চলেন
ঘরটা দেখেই আসবেন অ্যাঁক…।’
কথা শেষ হতে পেল না‚ পেঁচো হঠাৎ হেঁচকি তুলে থেমে গেল।
‘পেঁয়াজি করার জায়গা পাসনি!’ আচমকা
হেঁচকি তুলে থেমে যেতেই অন্ধকার ফুঁড়ে তৃতীয় ব্যক্তির আবির্ভাব। রোগা
লিকলিকে হলেও বেশ সৌম্যকান্তি চেহারা। গলায় মাজা পৈতে। ‘তালতলা শ্মশানের বেলগাছ নিয়ে তামাশা!’ বলতে
বলতে দাঁত কড়মড় করে উঠল তৃতীয় ব্যক্তির।
লোকটার দিকে তাকিয়ে ভিতরে যেন অনেকটা স্বস্তি
পেলে বিরূ। ফস
করে বলল‚ ‘দেখুন না ঠাকুরমশাই। সেই
থেকে উলটোপালটা কথা। বলে কিনা আমার মাথায় ঘিলু
নেই। নেহাত
রাতের বেলা…।’
‘সেই জন্যই তো চলে আসতে হল। আর
তোমাকেও বলি বাপু‚ কলকাতার ছেলে‚ যত খুশি পেঁয়াজি করো সেখানে গিয়ে। এখেনে
এই তালতলায় ওসবের দরকারটা কী? কীরে পেঁচো…।’
তৃতীয় ব্যক্তির কথা শেষ হতে পেল না। পেঁচো
হঠাৎ ‘বা–বা–গো’ বলে আর্ত চিৎকারে অন্ধকার ফুঁড়ে দৌড়। ঊর্ধ্বশ্বাসে
ছুটতে ছুটতেই এক ঝলক ঘাড় ফিরিয়ে চিৎকার করে বলল‚ ‘বিরূ‚ আমি
গৌর। পেঁচো
নই। তোকে
ভয় দেখাতে এসেছিলাম। পালিয়ে আয় শিগগির। উনি
তালতলার তিনি। সেই ব্রহ্মদত্যি।’
হঠাৎ এই ব্যাপারে বেজায় ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে
বিরূ সামনে সেই বামুন ঠাকুরের দিকে তাকিয়েছে‚ দমকা
বাতাসে কেমন দুলে উঠলেন তিনি। তারপর দুলতে দুলতে চারটে
হাত–পা ছিটকে গেল দেহ থেকে। শেষে দুলতে দুলতেই মিলিয়ে
গেল বাতাসে। ডানপিটে
ছেলে বিরূর জারিজুরি ততক্ষণে শেষ। মাথাটা ঘুরে উঠল হঠাৎ। ছুটে
পালাবে কী! বোঁ করে ঘুরে পড়ে গেল মাটিতে।
বিরূর জ্ঞান যখন ফিরল‚ হাতে আলো নিয়ে উদবিগ্নমুখে চারপাশে কয়েকজন
মানুষ। সঙ্গে
গৌরও রয়েছে। কাছের
এক গ্রাম থেকে সেই চ্যাঁচামেচি করে লোক জড়ো করে এনেছে। কালিঝুলি মাখা গায়ে তখনো
সেই পেঁচোর মেকআপ। আসলে বিরূকে নদীর ওপারে পাঠিয়ে দিয়ে একটু পরে
সে নিজেও পেঁচোর মেকআপ নিয়ে চলে এসেছিল তালতলার শ্মশানে। ডানপিটে
বিরূ যদি এমনিতে ভয় না পায় যথাসময়ে হাজির হবে সামনে। এমন ভয়ানক কাণ্ড হবে
ভাবেনি। এই
ঘটনার পর বিরূও আর দেরি করেনি। কলকাতার পথ ধরেছিল পরের
দিনই।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
4/2/2017
Heavy mojar :) :)
ReplyDeleteগল্পটায় কথকতার একটা আলাদা আমেজ পেলাম। অনেকগুলো সুতো মিলে তৈরি হয়েছে এ গল্পটি। সবচেয়ে ভালো লাগলো বিরূ আর গৌড়ের ঠান্ডা লড়াই যেখানে একজন অপদেবতা পর্যন্ত এসে সামিল হলো নিজের অস্তিত্বের স্বীকৃতি দাবি করতে। অতীত যে বর্তমানে নানাভাবে থেকে যায় সেটা বেশ এ কাহিনীতে ফুটে উঠেছে।
ReplyDeleteধন্যবাদ।
Deleteআপনার জন্য দাদা রোজ এত ভালোভালো গল্প পড়বার আর সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পাই। প্রতিদিন প্রতিটা গল্প বৈচিত্রময়। আজকের গল্পটাও এক কথায় অনবদ্য। আপনার অসুস্থতার সময় আপনাকে আর আপনার পোষ্ট গুলো প্রতিদিন বড্ড মিস করেছি। ভাল থাকুন দাদা, আর আমাদের এই ভাবেই ভাল ভাল গল্প পড়বার সুযোগ দিয়েছি সমৃদ্ধ করুন। 🙏💐💖
ReplyDeleteআপনার জন্য দাদা রোজ এত ভালোভালো গল্প পড়বার আর সমৃদ্ধ হবার সুযোগ পাই। প্রতিদিন প্রতিটা গল্প বৈচিত্রময়। আজকের গল্পটাও এক কথায় অনবদ্য। আপনার অসুস্থতার সময় আপনাকে আর আপনার পোষ্ট গুলো প্রতিদিন বড্ড মিস করেছি। ভাল থাকুন দাদা, আর আমাদের এই ভাবেই ভাল ভাল গল্প পড়বার সুযোগ দিয়েছি সমৃদ্ধ করুন। 🙏💐💖
ReplyDeleteঅনবদ্য লেখনী দাদা। আপনার জন্য প্রতিদিন এতো ভালো লেখা পড়বার সুযোগ পাই আর সমৃদ্ধ হতে পারি। প্রণাম নেবেন। 🙏❤️
ReplyDelete