Thursday 5 January 2017

গল্প (মোবাইল ভার্শন): হারজিত্‌ (শিশির বিশ্বাস)


জ কদিন ধরে সমানে বৃষ্টি ঘন দুর্যোগ কখনো ঝোড়ো হওয়া মজা নদীনালাগুলোও দু’কূল ছাপিয়ে গজরাচ্ছে কিন্তু এসব দমাতে পারেনি জেলার সাড়া জাগানো অনুর্দ্ধ আঠারো বয়সি ছেলেদের দশ মাইল দৌড় প্রতিযোগিতাকে সেই ১৯৪৭ সাল থেকে প্রতিযোগিতাটি নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে নির্দিষ্ট দিনে, নির্দিষ্ট সময়ে এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি
পঁচিশজন প্রতিযোগী আগের দিন যথাসময়ে পৌঁছে গেছে নূরপুর হাই স্কুলে রাতটা এখানে কাটিয়ে পরের দিন কাকভোরে স্টার্টারের সংকেত পেলেই বেরিয়ে পড়বে হাইওয়ে ধরে ছুটতে শুরু করবে
দৌড় প্রতিযোগিতার এত বছরের ইতিহাসে এবার একটা বিশেষ ঘটনা ঘটতে চলেছে গত দুবছর পর পর চ্যাম্পিয়ন হয়েছে জেলার সেরা দৌড়বীর অশোক মিত্র এবছরও যদি প্রথম হতে পারে, তাহলে হ্যাট্রিক করার এক দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হতে পারবে তবে এবার ওর সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দী সূতাহাটির সিরাজুল হক টগবগে তেজি ঘোড়া গতবারের প্রতিযোগিতায় তৃতীয় হয়েছিল তারপর এক বছরে অসাধারণ উন্নতি করেছে এবছর জেলার এক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় আটশো এবং দেড় হাজার মিটার দৌড়ের দুটি ইভেন্টেই সে ছিল অশোকের সবচেয়ে নিকটতম প্রতিদ্বন্দী অশোক দুটিতে জিতলেও লড়াই হয়েছে হাড্ডাহাড্ডি  শেষ মুহূর্তের আগে পর্যন্ত অশোককে নিশ্চিন্ত হতে দেয়নি সুতরাং সন্দেহ নেই সিরাজুল এবার লড়বে অশোকের সমর্থকদের তাই চিন্তার শেষ নেই কৌতূহলের শিকার কর্মকর্তারাও অশোক কি পারবে তার সম্মান ধরে রাখতে?
যাকে নিয়ে এত জল্পনা, তাকে দেখে কিন্তু কিছু বোঝার উপায় নেই উত্তেজনায় রাতে অনেকের চোখে ঘুম না এলেও অশোক সবার আগে শুতে গেছে তারপর ভোর হতে যথাসময়ে প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে স্টার্টিং পয়েন্টে
সারা রাত অঝোর বর্ষণের পর বৃষ্টির তেজ এখন কিছু কম পিঠে নম্বর আঁটা ডোরাকাটা গেঞ্জি আর প্যান্ট ভিজে সপসপ করছে মাথায় রানিং হ্যাট চোখের উপর সামান্য নামিয়ে দিয়ে বৃষ্টির ছাঁট যথাসম্ভব আটকে সমান তালে হাইওয়ে ধরে ছুটছে অশোক বৃষ্টির ফোঁটাগুলো তীক্ষ্ণ ফলার মতো বিঁধছে কিন্তু তাতে কাবু নয় ও এই রকম বৃষ্টি মাথায় করে সে বহুদিন প্র্যাকটিস করেছে এই হাইওয়ের উপর
পরপর কয়েকজন অতি উৎসাহী পিছন থেকে টপকে চলে গেল দৌড় সবে শুরু হয়েছে অশোক বিচলিত হল না দূর পাল্লার দৌড়ের নিয়মই এই গোড়ায় যত পারো দম ধরে রাখো অযথা খরচ করো না মাথা ঠাণ্ডা রাখো বিট্ করার জন্য অনেক সময় আছে কিন্তু দম হারিয়ে ফেললে সব শেষ যত প্রতিযোগীই থাক, বেশির ভাগই মাঝপথে দম হারিয়ে রণে ভঙ্গ দেয় আসল লড়িয়েদের দেখা পাওয়া যায় মাইল পাঁচেক পর থেকে আসল লড়াই তখনই শুরু হয়
ঠিক চার মাইলের মাথায় আমোদপুরের বাঁক বৃষ্টি অনেকটা ধরে এসেছে ইতিমধ্যে হাইওয়ের দুধার জলে থইথই ন্যাশানাল হাইওয়ে এখান থেকে বাঁ দিকে বেঁকে গেছে ডানদিকে আর একটা উঁচু কাঁচা রাস্তা আসলে এটা একটা বাঁধ মাইল কয়েক দূরে নদীর জল আটকাবার জন্য তৈরি হয়েছিল নদীর ধার দিয়ে নতুন পাকা বাঁধ তৈরি হবার পরে এখন আর তেমন গুরত্ব নেই আমোদপুরের বাঁকে ঘুরবার মুখে হঠাৎ ডান দিকে নজর পড়তেই চোখের পাতা কুঁচকে ওঠে অশোকের ততক্ষণে বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে ছুটতে ছুটতেই পিছন ফিরে তাকায় বাঁধের ডানদিক জলে থইথই করছে ঘোলা জল বড় বড় ঢেউ সমানে আছড়ে পড়ছে বাঁধের উপর ভীষণ টান জলের ভয়ানক একটা সন্দেহ ওর মাথার ভিতর উঁকি দিয়ে ওঠে, তবে কি নতুন বাঁধ ভেঙে বান আসছে? ঢেউয়ের এত তেজ কোত্থেকে আসে! এমন ভয়ানক ঘুর্ণি!
দূরপাল্লার দৌড়ে যেটা একেবারেই নিষেধ, তাই করে বসল আশোক দুম করে দাঁড়িয়ে পড়ে পায়ে পায়ে কাঁচা বাঁধের দিকে এগিয়ে গেল ব্যাপারটা একটু ভাল করে দেখে যাওয়া দরকার যদি সত্যিই নতুন বাঁধ ভেঙে গিয়ে থাকে, সম্ভবত এখনও এদিকে কারো নজরে পড়েনি পথে কাউকে পেলে সতর্ক করে দেবে মিনিট কয়েক পর্যবেক্ষণ করে অশোকের বুঝতে বাকি রইল না তার অনুমান অভ্রান্ত ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত হতে গিয়েও হঠাৎ খানিক দূরে চোখ পড়তে ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল বাঁধ ধরে এগিয়ে গেল সেদিকে
কী সর্বনাশ! পুরোনো কাঁচা বাঁধে সরু একটা ফাটল ধরেছে যে! চিনচিন করে জল চোঁয়াতে শুরু করেছে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই হয়তো জলের তোড়ে ভেঙে পড়বে বন্যার জলে তলিয়ে যাবে গ্রামের পর গ্রাম খেতের ফসল অশোক আর ভাবতে পারে না মুহূর্তে লাফিয়ে পড়ল ওধারে খেতের উপর তারপর জলকাদা ভেঙে ছুটতে শুরু করে দূরে গ্রামের দিকে
কিছক্ষণের মধ্যে সামনে একটা গ্রামে পৌঁছে উঁচু মতো একটা ঢিপির উপর উঠে দাঁড়ায় তারপর দুহাত মুখের দুপাশে এনে উদ্দাম কণ্ঠে হেঁকে ওঠে, ‘হে-এ-এ-ই- ঝুড়ি কোদাল বাঁশ খোঁটা যে যা হাতের কাছে পান, নিয়ে এক্ষুনি আমার সঙ্গে আসুন নদীর নতুন বাঁধ ভেঙে বান আসছে পুরোনো বাঁধেও ফাটল দেখা দিয়েছে এক্ষুনি মেরামত না করলে বন্যার হাত থেকে কেউ বাঁচবে না
দেখতে দেখতে কয়েকশো মেয়ে পুরুষ বৃষ্টি মাথায় করে বেরিয়ে এল ঘর থেকে কে চ্যাঁচায় অমন করে!
গাঁয়ের শীতলাতলার ভিটের উপর থেকে তখনও ভেসে আসছে বজ্রগম্ভীর স্বর, ‘গোয়ালে গোরু,মোষ যা আছে দড়ি খুলে দিন বাড়ির শিশু আর অক্ষমদের পাঠিয়ে দিন হাইওয়ের উপর বাকি সবাই ঝুড়ি কোদাল নিয়ে আমার সঙ্গে আসুন আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট নয়
একটু বাদেই দেখা গেল, গাঁয়ের কয়েকশো মেয়ে পুরুষ ঝুড়ি,কোদাল, বাঁশ,খুটি হাতে জল-কাদা ভেঙে ছুটছে বাঁধের দিকে সবার আগে এক কিশোর
বাঁধের ফাটল ধরে জল ততক্ষণে বেশ জোরেই চোঁয়াতে শুরু করেছে ওধারে থইথই জলের ঢেউ দেখে আতঙ্কে বোবা হয়ে যায় মানুষগুলো অশোক মুহূর্তে চাঙা করে তোলে তাদের, ‘হে--, ভয় পাবেন না কেউ জীবন পণ করে শপথ নিন সবাই মাটি ফেলুন বাঁধের উপর খোঁটা বসাতে থাকুন ঢেউয়ের সাধ্য নেই বাঁধ ভাঙে
মন্ত্রের মতো কাজ হয় মুহূর্তে ভিজে খেতের উপর কয়েকশো কোদাল পড়তে শুরু করে ঝুড়ি ভরতি মাটি পড়তে থাকে বাঁধের উপর কয়েক মিনিট ওদের কাজ লক্ষ্য করে অশোক বুঝতে পারে আরও মানুষ চাই আরও বাঁশখুঁটি পুরোনো বাঁধে এমন ফাটল আরও ধরতেই পারে বজ্রকণ্ঠে ফের হেঁকে ওঠে ও, ‘হে---, জনা কয়েক জোয়ান বাঁধ বরাবর টহল দিতে থাকুন এমন ফাটল আরও থাকতে পারে সামাল দেবার চেষ্টা করুন আমি আরও মানুষ নিয়ে আসছি মনে রাখবেন, মুহূর্তের জন্যও যেন কাজ বন্ধ না হয়
কথা শেষ করেই জনা কয়েক পুরুষকে সঙ্গে নিয়ে অশোক ফের জলকাদা ভেঙে ছুটতে শুরু করে আরও মানুষ চাই আশপাশের প্রতিটি গ্রামে এখনই পৌঁছে দিতে হবে এই সংবাদ
এদিকে বিজয়নগরে উপস্থিত সবাই অবাক হয়ে দেখল, সবার আগে ফিতে স্পর্ষ করল সিরাজুল তারপর একে একে আরও কয়েকজন কিন্ত অশোক কোথায়? চিন্তিত হয়ে পড়ল সবাই এমন হবার কথা নয় খানিক বাদে কর্মকর্তাদের কয়েকজন জীপ নিয়ে বেরিয়ে পড়ল তার খোঁজে
আমোদপুরের পুরোনো বাঁধের উপর যখন তারা অশোককে খুঁজে পেল, কর্তব্যরত কয়েক হাজার মানুষের সঙ্গে সে তখন মাটি তুলছে গায়ের স্পোর্টস গেঞ্জি কাদায় মাখামাখি হলেও পিঠের নম্বরটা তখনও উজ্জ্বল
এর পরের ঘটনা অনেকেরই জানা বাংলার সেই ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল একাধিক জেলা ভেসে গিয়েছিল গ্রামের পর গ্রাম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল প্রায় দুই কোটি মানুষ কিন্তু এক কিশোরের কর্মতত্পরতায় আমোদপুরের বাঁধ রক্ষা পেয়ে যেতে বেঁচে গিয়েছিল বারোটিরও বেশি গ্রাম, আর কয়েক হাজার মানুষ এছাড়া কয়েক কোটি টাকার সম্পদ সেই দুর্যোগের দিনে এই গ্রামগুলিতে আশ্রয় পেয়েছিল আশপাশের গ্রামের বহু গৃহহীন মানুষ আর গবাদি পশু
মাস কয়েক পরের কথা এক ভাবগম্ভীর অনুষ্ঠানে দৌড় প্রতিয়োগিতার পুরষ্কার বিতরণ করা হচ্ছে প্রথমেই পুরষ্কার নিতে উঠল বিজয়ী সিরাজুল হক তুমুল হর্ষদ্ধনির মধ্যে সভাপতির হাত থেকে পদকটি নিয়েই সে ছুটে নেমে এল মঞ্চ থেকে সামনের সারিতে বসা অশোকের কাছে এসে তার গলায় পরিয়ে দিল সেটা
কী ঘটল বুঝে ওঠার আগেই সিরাজুল ফের উঠে এল মঞ্চের উপর তারপর মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলতে শুরু করল, ‘উপস্থিত সুধীবৃন্দ আজকের এই পুরষ্কারের যোগ্য আমি নই স্পোর্টসম্যান অশোকের কাছে ভীষণভাবে হেরে গেছি আমি কাউকে বলতে পারিনি সেই দিনটির পরে কয়েক রাত আমি দু’চোখের পাতা এক করতে পারিনি সেদিন অশোকের আগেই ছিলাম আমি আমোদপুরের কাছে এসে জলের টান দেখে সন্দেহ আমারও হয়েছিল কিন্ত...
কথা শেষ করতে পারে না সিরাজুল দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে ফেলে ঝরঝর করে

ছবি: কিশোর ভারতী পত্রিকার সৌজন্যে
প্রথম প্রকাশিত: ‘কিশোর ভারতী’  শ্রাবণ ১৩৯১ 
আপলোড: ১০/৮/২০১৭

1 comment: