আসাম থেকে এক বন্ধু ঘন-ঘন পত্রাঘাত
করছিল, লিখছিল :
একবার এখানে এসে বেড়িয়ে যাও, বুঝবে
প্রকৃতিকে কেন লীলাচঞ্চল বলা হয়। একটু খোঁটা দিয়ে লিখেছিল, তোমরা পাহাড়-পর্বত কল্পনা
করো আর তারই বর্ণনা পাঠক-পাঠিকাকে উপহার দাও‚ অথচ ইট, কাঠ, পাথর ছাড়া কিছুই তোমরা
দ্যাখো না।
ভেবে দেখলাম অপবাদটা একেবারে মিথ্যে
নয়, তাই ওটা ঘোচাবার জন্যে বেরিয়ে পড়লাম।
বন্ধু যে এতটুকু বাড়িয়ে বলেনি তা
ট্রেনে যেতে-যেতেই টের পেলাম। জানলার ধারে বসে শুধু ঘন সবুজের শোভা আর পাহাড়ের সারি
অ-কবির মনেও কবিত্ব এসে যাওয়া বিচিত্র নয়।
বন্ধু স্টেশনে এসেছিল। আনন্দে ও আমাকে
জড়িয়ে ধরল, আমিও অভিভূত হলাম। দেবু, অর্থাৎ আমার বন্ধু, ওখানকার ডাক্তার। অল্প কিছুদিন
হল প্র্যাকটিস শুরু করেছে, কিন্তু ইতিমধ্যেই নাম করে ফেলেছে। এখনও বিয়ে করেনি—একা
থাকে। তাই আমাকে নিয়ে ও মেতে উঠল।
কয়েকটা দিন বেশ হইচই করে আনন্দে কেটে
গেল। শুনেছিলাম, আসামে রহস্য-রোমাঞ্চ পত্রিকার খুব কদর। দেবু আবার বেশ ফলাও করে আমার
নাম চাউর করে দিয়েছিল। বলেছিল, ওসব পত্রিকায় আমি নিয়মিত লিখি। ফলে, কিছু স্থানীয়
বাসিন্দা কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন, আমার সঙ্গে আলাপ করে আমাকে প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে
তুলেছিলেন। অবশ্য আমি যে মনে-মনে আত্মপ্রসাদ অনুভব করিনি এ-কথা বললে সত্যের অপলাপ করা
হবে। | একদিন সকাল দশটায় আমি দেবুর বাড়ির রাস্তার দিকের বারান্দায় একটা বই নিয়ে
বসেছি। মাঝে-মাঝে মুখ তুলে পথ দিয়ে লোকজনের চলাফেরা দেখছি। দেবু একজন রোগীর বাড়ি
গিয়েছিল, ফিরতে একটু দেরি হবে বলেছিল। গেট খোলার শব্দে আমি চোখ তুললাম।
যিনি এলেন তার নাম মিস্টার হাজারিকা,
দেবুরই একজন পেশেন্ট। দেবুর মুখেই শুনেছিলাম, ভদ্রলোকের বয়েস বেশি নয়। একসময় নাকি
খুব ভালো স্বাস্থ্য ছিল, কিন্তু গত ক'বছর ধরে তিনি কেমন যেন শুকিয়ে যাচ্ছেন। ভদ্রলোকের
দু-চোখ কোটরে ঢুকে গেছে, পাণ্ডুর মুখ, গায়ের রং অস্বাভাবিক ফ্যাকাসে, যেন একটা জীবিত
শব। ভদ্রলোকের রোগ যে আসলে কী, তা বহু পরীক্ষা করেও ধরা যায়নি। খিদে হয় না, ঘুম হয়
না, দিন-দিন শুকিয়ে যাচ্ছেন, অথচ সবরকম প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করেও শরীরে কোনও অস্বাভাবিকতা,
বা কিছুর অভাব, ধরা পড়েনি।
দেবুই বলেছিল, কেসটা বড় অদ্ভুত। সে
মেডিক্যাল জার্নালে ভদ্রলোকের কেস হিষ্ট্রি প্রকাশ করেছিল। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ তাকে বিভিন্ন
চিকিৎসা-পদ্ধতি বাতলে দিয়েছিলেন, কিন্তু তাতেও কোনও উপকার হয়নি।
আমার মুখে ‘ডাক্তারবাবু বাড়ি নেই’
শুনে তিনি বললেন, সেটা তিনি জানেন, আমার কাছেই তিনি এসেছেন। আমি ভদ্রতার খাতিরে তাকে
বসতে বললাম। মনে-মনে ভাবলাম, আমার কাছে আবার তার কী দরকার পড়ল!
একটা চেয়ার টেনে আমার মুখোমুখি তিনি
বসলেন। সত্যি কথা বলতে কী, ওই উজ্জ্বল দিনের আলো সত্ত্বেও তার সান্নিধ্য কেন জানি না
আমার অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল, গা ছমছম করে উঠল। যেন ওঁর উপস্থিতি অশরীরী আত্মার
কথা আমাকে মনে করিয়ে দিল।
ভদ্রলোক কোটরে ঢুকে যাওয়া দু-চোখ
দিয়ে আমাকে লক্ষ করছিলেন। হঠাৎ তাঁর ঠোটের ফাঁকে মৃদু কৌতুকের হাসি ঝিলিক খেলে গেল।
আমার অস্বস্তি আরও বেড়ে গেল।
ভদ্রলোক খুকখুক করে বারকয়েক কাশলেন।
তারপর যেন অনেকটা ক্ষমা চাওয়ার ভঙ্গিতে বললেন, ‘আপনাকে বিরক্ত করছি বলে যেন কিছু মনে
করবেন না...
‘আপনার কয়েকটা গল্প আমি পড়েছি, ভদ্রলোক
একটু থেমে বলতে লাগলেন, ‘অলৌকিক কাহিনি নিয়েই আপনি বেশি লেখেন…।’
একজন গুণমুগ্ধ পাঠক, এই ভেবে এতক্ষণে
আমি যেন ধাতস্থ হলাম।
‘আপনাকে আমি একটা কাহিনি শোনাতে চাই।’
ভদ্রলোক সোজাসুজি প্রসঙ্গ অবতারণা করলেন।
আমি নিজের প্রশংসা শুনব বলে প্রস্তুত
হচ্ছিলাম, হতাশ হলাম। যা হোক, মুখে বললাম, ‘বেশ তো বলুন, আমি শুনব।'
‘ধন্যবাদ।’ ভদ্রলোক ভাবলেশহীন মুখে
উক্তি করলেন। একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, ‘আমি জানি, আমার দিন ফুরিয়ে এসেছে,
এমনকী কবে মারা যাব তাও আমার অজানা নয়। তাই এখন আপনাকে বলতে কোনও বাধা নেই।’
আমি একটু চমকে উঠলাম। ভদ্রলোক বলেন
কী? কবে মারা যাবেন তাও তিনি জানেন!
‘একজনকে সব খুলে না বলা পর্যন্ত আমি
শান্তি পাচ্ছিলাম না। আপনিই উপযুক্ত লোক। দয়া করে আমার কাহিনি আপনি পত্রিকায় ছাপিয়ে
দেবেন। আমার অপরাধের কথা সবাই জানুক, তাই আমি চাই।' ভদ্রলোক তাঁর পাশের চেয়ারটার দিকে
মুখ ফেরালেন, যেন কেউ সেখানে বসে আছে, তাকে শুনিয়েই কথাটা বললেন।
আমার গা আবার শিউরে উঠল।
‘পাঁচ বছর আগে আমার চেহারা এমন ছিল
না, ভদ্রলোক আমার দিকে ফিরে শুরু করলেন‚ ‘আমি একজন ভালো অ্যাথলিট ছিলাম। শরীরে
মেদের বালাই ছিল না, অথচ পুষ্ট দেহ ছিল।
আমি এক চা-বাগানের হেড-অফিসে কাজ করতাম।
সেখানেই বড়ুয়ার সঙ্গে আমার আলাপ।’
ভদ্রলোক আবার চুপ করলেন, যেন পুরোনো
দিনের কথায় নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। তারপর আমার দিকে ফিরে বলতে লাগলেন, ‘বড়ুয়া আমার
থেকে বয়েসে ছোট হলেও আগেই ওই অফিসে ঢুকেছিল। বেশ সুন্দর চেহারা, অনেকটা মেয়েলি ধরনের।
ওর বাড়ি লামডিংয়ে, এখানে একটা ঘর ভাড়া করে ও ছিল। প্রথম থেকেই কেন জানি না ও আমার
প্রতি আকৃষ্ট হয়। আমার থাকার জায়গা নেই, হোটেলে আছি, শুনে ওর সঙ্গে থাকার জন্যে পীড়াপীড়ি
করতে থাকে। আমিও ভেবে দেখলাম তাতে আমার অনেক সুবিধে। যা মাইনে পাই তার বেশিরভাগ হোটেলের
খরচায় চলে যায়। তার চাইতে ওর সঙ্গে শেয়ার করে থাকলে অনেক কম খরচ হবে। রান্নার জন্যে
একজন লোক রেখে দিলে আরও সুরাহা হবে।
আমি ওর প্রস্তাবে সম্মত হলাম। বেশ
কিছুদিন কেটে গেল। ভালোই ছিলাম, টাকা-পয়সাও বাঁচছিল। বড়ুয়া ক্রমেই আমার একান্ত অনুগত
হয়ে পড়ল। আমার সুখ-সুবিধের দিকে ওর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ করে আমি বেশ মজা পেতাম। ক্ৰমে
এমন অবস্থা হল যে, ও যেন আমার মধ্যে নিজের সত্তাকে হারিয়ে ফেলল। মাঝরাতে আমি ওকে সিগারেট
আনতে বললে, এক মাইল হেঁটে তাও এনে দিতে ও এতটুকু বিরক্তি প্রকাশ করত না, বরং আমাকে
খুশি করতে পেরে ও যেন তৃপ্ত হত। এককথায়, আমার জন্যে সব ত্যাগ করতে ও প্রস্তুত ছিল।
‘দেখতে-দেখতে কয়েকটা বছর গড়িয়ে
গেল। আমার মধ্যে একটা পরিবর্তন এল। এতদিন আমি বড়ুয়ার এই আত্মনিবেদনে আত্মতুষ্টি অনুভব
করতাম, কিন্তু আর যেন ওকে ভালো লাগে না। এই একঘেয়েমি, বৈচিত্র্যহীনতা অসহনীয় মনে
হতে লাগল। ওর এই মেয়েলি স্বভাব আমার দু-চোখের বিষ হয়ে উঠল। আমি যেন হাঁপিয়ে উঠলাম।
ওর সঙ্গ ত্যাগ করবার চেষ্টা করলাম, কিন্তু কিছুতেই ওকে কাছছাড়া করতে পারলাম না। বড়ুয়া
নানা ছল-ছুতো করে আমার আলাদা থাকার ব্যবস্থা পণ্ড করে দিতে লাগল। আমি মনে-মনে রেগে
উঠলাম। ওর সঙ্গে নিষ্ঠুরের মতো ব্যবহার করতে লাগলাম। তাতে ওর মুখে ব্যথার চিহ্ন ফুটে
উঠত‚ আর সেটা
লক্ষ করে আমি উল্লাস বোধ করতাম। নিজের অজান্তেই আমি হিংস্র হয়ে উঠছিলাম। এসব সত্ত্বেও
বড়ুয়া কিন্তু আমাকে ছাড়ল না, ছায়ার মত আমার পাশে-পাশে থাকত।
‘শেষ পর্যন্ত আমি মরিয়া হয়ে উঠলাম।
ওর হাত থেকে আমাকে নিষ্কৃতি পেতেই হবে। অনেক ভেবে-চিন্তে ঠিক করলাম, ওকে আমি খুন করব।
আমি মতলব আঁটতে লাগলাম। এমনভাবে কাজ হাসিল করতে হবে যাতে আমার ওপর সন্দেহ না আসে। শেষ
পর্যন্ত সকলের চোখের সামনেই একটা দুর্ঘটনা ঘটিয়ে দিলাম‚ আমাকে সন্দেহ করার কোনও কারণই ছিল
না।
‘হাসপাতালে শেষ নিশ্বাসের আগে ও আমার
দিকে চোখ মেলে তাকাল। সেই চোখে রাগ। বা অভিযোগ ছিল না‚ ছিল ভর্ৎসনা। বিড়বিড় করে ও বলল,
আমাকে তুমি ফাঁকি দিতে পারবে না‚ তোমার পাশে ছায়ার মতো আমি থাকব।’
মিস্টার হাজারিকা একটু থামলেন। আমি
ওঁর স্বীকারোক্তি শুনে যেন সংবিৎ হারিয়ে ফেলেছি।
‘বড়ুয়া ওর কথা রেখেছে,’ হাজারিকা
আবার শুরু করলেন‚ “মৃত্যুর পর-মুহূর্ত থেকে ছায়ার মতো ও আমার পাশে-পাশে রয়েছে।
দিনেরাতে সবসময় আমি ওর উপস্থিতি অনুভব করি। এখনও ও আমার পাশে বসে আছে।’ হাজারিকা পাশের
চেয়ারের দিকে ঘাড় ফেরালেন।
আমার মেরুদণ্ড দিয়ে যেন একটা হিম-শিহরন
বয়ে গেল। আমিও যন্ত্রের মতো ঘাড় ফেরালাম, আর সঙ্গে সঙ্গে আঁতকে উঠলাম। আমার স্পষ্ট
মনে হল, যেন কেউ চেয়ারে বসে আছে, একটা আবছা ছায়ামূর্তি।
আমার মাথা ঘুরে উঠল। একটু ধাতস্থ হয়ে
আবার চেয়ারের দিকে তাকালাম। এবার কিন্তু কিছু দেখতে পেলাম না।
মিস্টার হাজারিকা আমার মুখের দিকে
তাকিয়েছিলেন। তার মুখে বিচিত্র এক হাসি ফুটে উঠল। তিনি বললেন, ‘জানেন, ও আমার কানে
ফিসফিস করে কথা বলে। তাই আজ আমি সাহস করে সব কথা আপনাকে খুলে বলতে ভরসা পাচ্ছি। কারণ,
ও আমাকে বলেছে, আর মাত্র একটা মাস আমার আয়ু।’ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হাজারিকা বললেন,
‘মরেও আমি ওর হাত থেকে নিষ্কৃতি পাব না।’
তিনি উঠে দাঁড়ালেন। আমার স্পষ্ট মনে
হল, আর-একজন কেউ পাশের চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। আমাকে ধন্যবাদ জানিয়ে হাজারিকা হাঁটতে
শুরু করলেন, আর আমি দ্বিতীয়বার ভয়ানক চমকে উঠলাম।
মাথার ওপর কড়া রোদ। মিস্টার হাজারিকা
হাঁটছেন, তাঁর পাশে-পাশে তার ছায়াও চলছে। কিন্তু..ছায়া একটা নয়, দুটো...।
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
আপলোড: ১০/৯/২০১৭
Khub bhalo laglo....
ReplyDeleteখুব ভাল
ReplyDeleteDarun.
ReplyDeleteHeart touching and scary story.
ReplyDeleteI really love it.
Great! খুব ভালো লাগলো গল্পটি পড়ে!
ReplyDeleteদারুণ
ReplyDelete