Thursday 2 January 2020

ভাললাগা রোমাঞ্চ গল্প (মোবাইল ভাঃ): গোপন বাহিনী (প্রেমেন্দ্র মিত্র)


গোপন বাহিনী
প্রেমেন্দ্র মিত্র
পৃথিবীতে অনেক রকম যুদ্ধ হয়েছে। ছলে বলে কৌশলে নানাভাবে এক দেশ আর এক দেশকে জয় করেছে। কিন্তু সামান্য একটা রাজ্য ইকোয়েডর তার প্রবল পরাক্রান্ত উদ্ধত ও অত্যাচারী প্রতিবেশী পেরুকে যেভাবে জব্দ করেছিল তার তুলনা আর কোথাও মেলে না। আজ সেই যুদ্ধের গল্পই বলব।
দক্ষিণ আমেরিকার সমস্ত রাজ্যগুলির ভেতর সবচেয়ে গরিব বুঝি ইকোয়েডর। সামান্য কয়েকটা খনি, পাহাড়ের ধারে কিছু জঙ্গল ও পশ্চিমের সমুদ্রকূলে সামান্য গুয়ানো মানে পাখির তৈরি জমির সার ছাড়া তার আর কোনো আয়ের উপায় নেই। দক্ষিণ দিকে তার প্রতিবেশী রাজ্য হল পেরু। পেরুর অবস্থা ইকোয়েডরের চেয়ে অনেক ভালো। চাষবাস সেখানে তেমন প্রচুর হয় না বটে কিন্তু চাষের দামি সার হিসাবে গুয়ানো বিক্রি করে তার প্রচুর আয়। তা ছাড়া আয়তনে ইকোয়েডরের চেয়ে বড়ো বলে তার খনিজ সম্পদও অনেক বেশি।
দক্ষিণ আমেরিকার রাজ্যগুলি অনেকটা ঝগড়াটে অসভ্য মানুষের মতো। রাজ্যগুলি সর্বদাই এ-ওর পেছনে লেগে আছে। কেমন করে পরস্পরকে জব্দ করবে সেই ফন্দিই তারা আঁটছে সর্বদা। একজনের যদি একটু অবস্থা ফিরেছে তাহলে তো আর কথা নেই, আশপাশের প্রতিবেশীরা তার দৌরাত্ম্যে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠবে।
পৃথিবীতে চাষের সারের জন্যে ফসফেট অত্যন্ত দরকারি। এই ফসফেট সম্পদ পেরুর মতো পৃথিবীর আর কোনো রাজ্যের নেই। তার পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে অসংখ্য গুয়ানো পাখি অফুরন্ত ভাবে এই ফসফেট সার তৈরি করে চলেছে। সেই ফসফেট পৃথিবীর বাজারে চড়া দামে বিক্রি করে পেরু কয়েক বছর হল বেশ ফেঁপে উঠেছিল। তারপর আর কী! পেরু রাজ্যের দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না বললেই হয়। তার দাপটে প্রতিবেশী ছোটো ইকোয়েডরের প্রাণান্ত হবার উপক্রম।
একে ইকোয়েডর গরিব। না আছে তার অর্থবল না আছে লোকবল, তার ওপর গত দু-বছর কটোপ্যাক্সি ও শিম্বোরাজো নামক দুটি আগ্নেয়গিরির উৎপাতে সে বেশ কাবু হয়ে আছে। এমন সময় নতুন পয়সার গরমে পেরু তার ওপর জুলুম শুরু করল। পেরু ও ইকোয়েডরের মাঝখানের সীমান্তরেখা স্বাভাবিক নয়। অর্থাৎ কোনো নদী বা পর্বতশ্রেণী ধরে এই দুটি রাজ্যের সীমা নির্দিষ্ট হয়নি। কাল্পনিক একটা রেখা দুটি রাজ্যকে ভাগ করে রেখেছে। হঠাৎ একদিন দেখা গেল, পেরু রাজ্যের কল্পনা অত্যন্ত বেড়ে যাচ্ছে। ইকোয়েডরের সীমা পেরিয়ে তার একদল সৈন্য হঠাৎ একদিন ছাউনি পেতে বসল। ইকোয়েডর মৃদু একটু আপত্তি জানাল। কিন্তু কে কথা শোনে! পেরুর সৈন্যেরা উত্তরে বরং আর একটু এগিয়ে গিয়ে ছাউনি গাড়লে। ইকোয়েডর এবার পেরুর কাছে কৈফিয়ত চেয়ে পাঠাল একটু কড়াভাবেই। কিন্তু এতে হল হিতে বিপরীত। পেরু রেগে আগুন হয়ে উঠল। এত বড়ো আস্পর্ধা ইকোয়েডরের মতো একটা ছোটো রাজ্যের যে, সে কৈফিয়ত চেয়ে পাঠায়! পেরুর সৈন্য যেখানে ছাউনি গেড়েছে সেটাই যে পেরুর সীমান্তরেখা নয় তা কে বললে? পেরু ইকোয়েডরের প্রতিনিধিদের রীতিমতো ধমকে বিদায় করে দিল।
অবস্থা খারাপ হলে প্রবলের হাতে মানুষকে অনেক সহ্য করতে হয়। ইকোয়েডর এ অপমানের বিরুদ্ধেও বিশেষ কিছু করত না। কিন্তু হঠাৎ আরেক গোলমাল বেধে গেল।
বাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড় কথাটা একেবারে মিথ্যে নয়। পেরুর সৈন্যদলের প্রত্যেকটি লোক এক-একটি নবাব। তা ছাড়া ধরে আনতে বললে বেঁধে আনতে তারা কখনো ভোলে না। ইকোয়েডরের রাজ্যে গিয়ে ছাউনি গেড়ে তারা তাদের নবাবি মেজাজের ভালো করেই পরিচয় দিতে আরম্ভ করল। যেখানে সৈন্যেরা আড্ডা গেড়েছে, সেখানে ইকোয়েডরের চাষি ও পশুপালকদের বাস। সেই পশুপালকেরা সৈন্যদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। সৈন্যেরা খেয়ালমতো চাষিদের বাড়িতে গিয়ে হানা দেয়, জোরজবরদস্তি করে তাদের কাছে খাবার আদায় করে, ইচ্ছেমতো তাদের পালিত পশু ধরে নিয়ে এসে ভোজের আয়োজন করে।
মানুষের দেহে আর কত সয়! ছাউনির কাছাকাছি চাষি ও পশুপালকেরা অনেক সহ্য করে একদিন মরিয়া হয়ে খেপে উঠল। তার আগের দিন এক চাষি সৈন্যদলের আবদার মেটাতে একটু আপত্তি করেছিল বলে তারা মজা করে তার গোলাবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। সৈন্যদলের এই মজা করাটা চাষি ও পশুপালকেরা কিন্তু অন্য দৃষ্টিতে দেখেছিল। অত্যাচার তাদের সহ্যশক্তি তখন ছাড়িয়ে গেছে। ভেতরে ভেতরে তারা প্রতিশোধের জন্য তখন প্রস্তুত হচ্ছে।
সেদিন সৈন্যদের একটা দল বেড়াতে বেড়াতে সেখানকার এক অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন পশুপালকের বাড়ি গিয়ে উঠেছে। উঠেই তাদের হরেকরকম বায়না ভালো মাংস রেঁধে নিয়ে এসো, ভাঁড়ারে খাবারদাবার কী আছে আগে বার করো, সবচেয়ে ভালো ঘরটায় আজ আমরা থাকব তার ব্যবস্থা করো ইত্যাদি। পশুপালকের লোকজন চাকরবাকর অনেক। সাধারণ মারামারি হলে তারা একটা সৈনিককে মাটিতে ধুলো করে গুঁড়িয়ে দিতে পারে। কিন্তু সৈন্যদের পিছনে আছে সমস্ত বাহিনী। তাদের অস্ত্রশস্ত্র সব আছে। সেই ভয়েই বোধ হয় সেনর গোভানি ও তার লোকজন মনের রাগ মনেই রেখে নীরবে সৈনিকদের সমস্ত অন্যায় আবদার সহ্য করছিলেন। কিন্তু সৈনিকেরা ক্রমশই মাত্রা ছাড়িয়ে গেল।
সৈনিকেরা খেতে বসেছে। সেনর গোভানিকে বাধ্য হয়ে তাদের খাওয়াদাওয়া তদারক করতে হচ্ছে, এমন সময় নিজের প্লেট থেকে প্রকাণ্ড এক মাংসের চাঁই তুলে এক সৈনিক ডাকল, ‘গোভানি!’
সেনর গোভানি শান্তভাবে বললেন, ‘কী?’
সৈনিক উদ্ধতভাবে বলল, ‘এইরকম বিশ্রী রান্না মাংস কী বলে তুমি আমাদের খেতে দিয়েছ?’
সেনর গোভানি এ ঔদ্ধত্যেও বিচলিত না হয়ে সংযত ভাবে বললেন, ‘কী করব! আমাদের এখানে ওর চেয়ে ভালো রান্না হয় না।’
‘হয় না! বটে! তবে এ মাংস তুমিই খাও।’ বলে সৈনিক সেই মাংস সেনর গোভানির মুখের ওপর ছুঁড়ে মারল। মাংসের ডেলা সেনর গোভানির মুখে গিয়ে সজোরে লাগল। মুখ থেকে তাঁর জামায় পর্যন্ত মাংসের কাঁই মাখামাখি হয়ে গেল।
সৈনিকেরা সে দৃশ্য দেখে উচ্চস্বরে সবাই হেসে উঠল। অপমানে, ক্ষোভে সেনর গোভানি তখন কাঁপছেন।
এ অপমান অসহ্য! সেনর গোভানির লোকজন এবার আর স্থির থাকতে পারল না। যে সৈনিক মাংসের ডেলা ছুঁড়েছিল, একজন এসে এক প্রচণ্ড ঘুসিতে তাকে চেয়ার থেকে উলটে মাটিতে চিৎপাত করে দিল। তারপরেই শুরু হল মারামারি।
চাষিরা তখন রীতিমতো খেপে গেছে, পরিণামের ভয় আর নেই। সৈনিকদল তাদের কাছে মার খেয়ে একরকম ছাতু হয়ে গেল বললেই হয়। বেদম প্রহারের ফলে তাদের একজন মারাও গেল পরদিন।
পেরু বুঝি এমনি একটি ছিদ্রই খুঁজছিল। সমস্ত রাজ্যে তাদের রটে গেল যে, ইকোয়েডরের লোকেরা পেরুর নিরীহ সৈনিকদের অসহায় অবস্থায় পেয়ে মেরে ফেলেছে। এর প্রতিকার চাই।
ইকোয়ডরের শাসনকর্তারা হঠাৎ পেরুর এক কড়া চিঠি পেয়ে অবাক হয়ে গেলেন। পেরু রাজ্যের নিরীহ প্রজাদের মেরে ফেলার দরুন ইকোয়েডরের কাছে পেরু শুরু কৈফিয়ত চেয়ে পাঠায়নি, ক্ষতিপূরণ স্বরূপ আরও কিছু চেয়ে পাঠিয়েছে। খেসারত স্বরূপ ইকোয়েডরকে তার গুয়াকুইল বন্দরটি পেরুকে দিতে হবে।
এমন অদ্ভুত কথা কেউ কখনো শোনেনি। পেরুর দম্ভ অত্যন্ত বেড়েছে, কিন্তু সামান্য একটা মারামারির ফলে যা হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ পেরু যে এই বন্দরটা চেয়ে বসতে পারে এতটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি। পেরুর নিজের কোনো ভালো বন্দর নেই। গুয়াকুইল বন্দরের জন্যে সে যে বহুদিন ধরে ইকোয়েডরকে ঈর্ষা করে এটাও ঠিক। কিন্তু তাই বলে এই অর্থহীন ছুতোয় সে যে সেটা দাবি করতে পারে একথা ভাবা যায় না!
পেরুর আবদার যত অসম্ভবই হোক, তাকে একটা উত্তর তো দিতে হবে । ইকোয়েডর জানাল যে, সীমান্তের কাছে সৈন্যদের সঙ্গে ইকোয়েডরের পশুপালকদের যে মারামারি হয়েছে তার জন্যে সত্যি কথা বলতে গেলে পেরুই দায়ী। তারাই সীমান্তরেখা অন্যায়ভাবে অতিক্রম করেছে। যাই হোক, মারামারির কারণ ও বিবরণ জানাবার জন্যে রাজধানী থেকে রাজপ্রতিনিধি কয়েকজন যাচ্ছেন। তাদের অনুসন্ধানের ফলাফল জানা গেলে যা উচিত। ইকোয়েডর তাই করবে।
ইকোয়েডরের কথা যে যুক্তিযুক্ত, তা সবাই স্বীকার করবে। কিন্তু পেরু এ উত্তরে সন্তুষ্ট হওয়া দূরে থাক, ভীষণ রেগে গিয়ে একেবারে চরম পত্র দিয়ে বসল। তিনদিনের মধ্যে ইকোয়েডরের লোক যেন গুয়াকুইল বন্দর ছেড়ে চলে যায় না গেলে তাদের বিপদ আছে।
এ তো একেবারে রীতিমতো যুদ্ধ ঘোষণা! বোঝা গেল পেরু বহুদিন ধরে যেকোনো ফিকিরে এমনই যুদ্ধ বাধাবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে আছে। তাদের সাজসরঞ্জামও বোধ হয় সম্পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু ইকোয়েডর যে মোটেই তৈরি নেই! ইকোয়েডরের শাসনকর্তারা রীতিমতো ভড়কে গেলেন। ইকোয়েডরের উত্তরে কলম্বিয়া। পেরুর উৎপীড়ন ও অন্যায় আবদারের কথা জানিয়ে শাসনকর্তারা কলম্বিয়ার কাছে সাহায্য চাইলেন। দূরে হলেও ব্রাজিল সরকারের কাছেও লোক পাঠানো হল। কিন্তু ফল কিছুই হল না। চোরে চোরে সবাই মাসতুতো ভাই। পরের বিপদে সাহায্য করা দক্ষিণ আমেরিকার রাজ্যগুলির স্বভাব নয়। ফাঁপরে পড়ে একরকম নতজানু হয়েই ইকোয়েডরের কর্তারা পেরুকে ন্যায়ের দোহাই দিয়ে তার অন্যায় দাবির কথাটা ভেবে দেখতে বললেন। কিন্তু চোরা না শোনে ধর্মের কাহিনি। পেরু জানাল, গুয়াকুইল বন্দর তার চাই।
নিরুপায় হয়ে শাসনকর্তারা যুদ্ধের জন্যে এবার প্রস্তুত হবার চেষ্টা করলেন। বন্দরটা তো আর অমনি দিয়ে দেওয়া যায় না! গুয়াকুইল বন্দর গেলে আর ইকোয়েডরের রইল কী?
কিন্তু মুখের কথা বার করলেই তো আর যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হওয়া যায়! পেরু বড়োলোক হওয়ার পর যুদ্ধের বিস্তর সরঞ্জাম সংগ্রহ করে ফেলেছে। তার এরোপ্লেন আছে, তার নতুন ধরনের কামান আছে, তার গোলাগুলি অঢেল, লোকজনও তার ঢের বেশি। ইকোয়েডরের শুধু যে লোকজন নেই তা নয়, এরোপ্লেন বা নতুন ধরনের কামান-বন্দুকও তার কম। তবু তাকে সাজতে হল।
পেরু যে তিন দিন ইকোয়েডরকে সময় দিয়েছিল, সে-তিন দিন শেষ হওয়ামাত্র তাদের বাহিনী ওপর ও নীচ থেকে গুয়াকুইল আক্রমণ করল। বন্দরের লোকেরা নীচেকার সৈনবাহিনীকে যদি বা ঠেকাল ওপরের এরোপ্লেনের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারল না। ওপর থেকে বোমা ফেলে পেরুর লোকেরা বন্দরের অধিবাসীদের একেবারে ব্যতিব্যস্ত করে তুলল। একদিন, দু-দিন কোনোরকমে কাটল, কিন্তু তৃতীয় দিন বন্দর রাখা দায় হয়ে উঠল। পেরু সেই সঙ্গে জানাল যে ইকোয়েডর এখন যদি সহজে গুয়াকুইল বন্দর ছেড়ে না দেয়, তাহলে শুধু তো গুয়াকুইল বন্দর নিয়ে পেরু রাজ্য সন্তুষ্ট থাকবে না, যুদ্ধে তাদের যে অর্থব্যয় হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ স্বরূপ সমুদ্রের তীরের যে গুয়ানো সারের দ্বীপগুলো ইকোয়েডরে আছে, তাও কেড়ে নেবে।
ভীত হয়ে ইকোয়েডরের শাসনকর্তারা এক সভা আহ্বান করলেন সেইদিনই। গুয়াকুইল বন্দর তো রাখা যাবেই না, তার ওপর গুয়ানো সারের দ্বীপও যদি দিতে হয়, তাহলে তো সর্বনাশ! অনেক মন্ত্রীই তাই ভেতরে ভেতরে গুয়াকুইল বন্দর পেরুকে ছেড়ে দেবার পক্ষপাতী। সভায় তাঁরা সেই প্রস্তাবই করবার মতলব করছেন।
বিকেলে সভা বসবে। রাষ্ট্রপতি দু-ধারে রক্ষী–প্রহরী নিয়ে সভায় চলেছেন গাড়ি চড়ে। হঠাৎ গাড়ির সামনে একটা গোলমাল হল। কে একটা পাগলাগোছের লোক তাঁর গাড়ির পথ রুখেছে। সে নাকি রাষ্ট্রপতির সঙ্গে কথা বলতে চায়। প্রহরীরা তাকে ঘাড় ধাক্কা মেরে তাড়িয়ে দিল, কিন্তু লোকটা তবু নাছোড়বান্দা। পাগলের মতো ছুটে এসে গাড়ির দরজা ধরে সে বলল, ‘দোহাই আপনার রাষ্ট্রপতি, আমায় দুটো কথা বলবার অনুমতি দিন।’‘
রাষ্ট্রপতি অবাক হয়ে দেখলেন, পাগলাগোছের লোকটার বয়স অত্যন্ত অল্প। তার ব্যগ্রতা দেখে তার কেমন একটু কৌতূহল হল। প্রহরীরা আবার এসে যুবকটিকে সরিয়ে দেবার চেষ্টা করছিল। তাদের বাধা দিয়ে রাষ্ট্রপতি যুবককে তাঁর গাড়ির ভেতর এসে বসতে বললেন। তারপর আবার গাড়ি চালাতে হুকুম দিয়ে তিনি যুবকটির দিকে চাইলেন। মাথার উসকোখুসকো চুলের ভেতর হাত বুলিয়ে যুবকটি এক নিশ্বাসে বলে গেল, ‘আমার নাম আলেপ্পো গোভানি। ইকোয়েডরের সীমান্তে যে সেনর গোভানির লোকের সঙ্গে সৈনিকদের মারামারি হয়, আমি তাঁরই ছেলে। যখন মারামারি হয় তখন আমি বাড়িতে ছিলাম না। পাহাড়ে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো আমার একটা নেশা। কটোপ্যাক্সির ধারে আন্ডিজ পাহাড়ের জঙ্গলে তখন আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি।’
রাষ্ট্রপতির এবার সত্যি সন্দেহ হল যুবকটি পাগল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কিন্তু আমায় এসব শোনানো কেন?
‘বলছি, রাষ্ট্রপতি। বেড়ানো শেষ করে আমি কদিন আগে বাড়িতে ফিরেছিলাম। ফিরে কী দেখলাম জানেন? আমাদের কাছে মার খেয়ে সেই আক্রোশে পেরুর সৈন্যরা আমাদের সমস্ত বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে। আমার বাবা নিহত। আমার ভাইবোনেরা কোথায় গেছে কোনো পাত্তা নেই।’
রাষ্ট্রপতি বলতে যাচ্ছিলেন, আমি তার প্রতিকার কী—
তার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে গোভানি বলল, ‘প্রতিকার আপনাকে করতে হবে না। আমি তার উপায় জানি। সেই কথাই আপনাকে বলতে এসেছি।’
রাষ্ট্রপতি পাগলের কথায় একটু হেসে বললেন, ‘তুমি কী প্রতিকার করবে! কাল তো যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে।'
‘যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাবে?’ গোভানির চোখ-মুখ দিয়ে যেন আগুন বেরোচ্ছিল! ‘এই অপমান লাঞ্ছনা মাথা পেতে নিয়ে কাপুরুষের মতো আপনারা যুদ্ধ বন্ধ করবেন? গুয়াকুইল বন্দর রক্ষা করবেন না?’
‘কী করে আর করব!' বলে রাষ্ট্রপতি হতাশভাবে সামনের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর যেন নিজের মনে বললেন, ‘আমাদের অস্ত্র নেই, সৈন্য নেই। যুদ্ধ আমরা কী নিয়ে করব?’
গোভানি উত্তেজিত স্বরে বলল, ‘যুদ্ধ করব সৈন্য নিয়ে। আমাদের কোটি কোটি অক্ষৌহিণী সৈন্য আছে, সমস্ত পেরু আমরা শ্মশান করে দিতে পারি!’
দুঃখের ভেতরেও পাগলের কথায় একটু হেসে রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘তাই নাকি?’
‘আপনি আমার কথায় বিশ্বাস করছেন না? তা না করাই স্বাভাবিক। কিন্তু আগে আমার কথা শুনুন।’ গোভানি রাষ্ট্রপতির আরও কাছে মুখ এনে মৃদুস্বরে অনেকক্ষণ ধরে কী বলল। শুনতে শুনতে দেখা গেল রাষ্ট্রপতির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। সমস্ত কথা শুনে সোজা হয়ে বসে গোভানির পিঠ চাপড়ে তিনি বললেন, ‘এ যদি সম্ভব হয়, তাহলে সমস্ত ইকোয়েডর তোমার কাছে ঋণী হয়ে থাকবে চিরকাল।’
‘এ সম্ভব যে হবেই!’ বলে এতক্ষণে গোভানি একটু হাসলে।
রাষ্ট্রপতি তবু ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘কিন্তু মন্ত্রীসভা যদি আমার কথায় কান না দেয়! তারা ভয়ে অস্থির হয়ে আছে। যেকোনো শর্তে সন্ধি করতে পারলে বাঁচে।’
গোভানি বললে, ‘আপনি ভুলে যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি যে, যুদ্ধের সময় বিশেষ ক্ষমতা দ্বারা আপনি মন্ত্রীসভা ভেঙে দিয়ে সমস্ত দায়িত্ব নিজের স্কন্ধে নিতে পারেন।’
সেদিন সভায় যা হল তা আর বলে কাজ নেই। অধিকাংশ মন্ত্রী ও রাজকর্মচারীরা পেরুর সঙ্গে সন্ধি করার পক্ষপাতী। গুয়াকুইল বন্দর দিলে যদি তারা সন্তুষ্ট হয় তাহলে তাই দেওয়া হোক। দেশের নইলে আরও বেশি ক্ষতি হবে। একা রাষ্ট্রপতি তাদের অনেক বোঝালেন। এভাবে হার স্বীকার করলে পেরুর আস্পর্ধা ক্রমশই বেড়ে যাবে আজ গুয়াকুইল বন্দর যারা চেয়েছে কাল তারা সমস্ত রাজত্বই যে চাইবে না তা কে বলতে পারে? তা ছাড়া এ অন্যায় সহ্য করার চেয়ে প্রাণ দেওয়া ভালো!
কিন্তু মন্ত্রীসভার অধিকাংশই তার বিরুদ্ধে। কিছুতেই যখন তাদের বোঝানো গেল না, তখন হঠাৎ রাষ্ট্রপতি সকলকে ঘোষণার দ্বারা চমকে দিলেন। মন্ত্রীরা যদি তাঁর কথায় না সায় দেন। তাহলে তিনি সমস্ত সভা ভেঙে দেবেন। যুদ্ধের সময় এরকম ভাঙবার ক্ষমতা তাঁর আছে। সমস্ত সভা নিস্তব্ধ, স্তম্ভিত। একজন অনেকক্ষণ বাদে মৃদুস্বরে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনি তাহলে এখন কী করতে বলেন? আর সৈন্য সংগ্রহ, যুদ্ধের ব্যয়ের জন্য অতিরিক্ত কর আদায়?’
‘আমি সেসব কিছুই বলি না। শুধু গুয়াকুইল বন্দর ছাড়তে অস্বীকার করে আমরা কটোপ্যাক্সির আশেপাশের পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগাব।’
‘পাহাড়ে আগুন লাগাবেন!’ খানিকক্ষণ স্তম্ভিত হয়ে থেকে হঠাৎ সমস্ত সভার লোক হেসে উঠল। রাষ্ট্রপতির মাথা নিশ্চয়ই খারাপ হয়েছে। একজন বলল, আপনি বলছেন কী?
‘আমি ঠিকই বলছি! আমাদের শুধু আত্মরক্ষা নয়, পেরুর অত্যাচারের প্রতিশোধ নেবার একমাত্র উপায় পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগানো। আজ এই মুহূর্তেই আমার বন্ধু এই আলেপ্পো গোভানির নেতৃত্বে একটি সৈন্যবাহিনীকে পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন লাগাবার জন্যে পাঠানো হবে।’
সভাসদেরা একথার পর বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে বিদায় নিলেন। রাষ্ট্রপতির যে মাথা খারাপ হয়েছে এবং তাকে যে পদ থেকে সরানো দরকার, এবিষয়ে তারা সকলেই একমত। কিন্তু রাষ্ট্রপতিকে তো আর মুখের কথায় পাগল বলে দূর করে দেওয়া যায় না, তার জন্যে আয়োজন চাই। তারা সেই আয়োজনই করবার সংকল্প করলেন।
তারপর একদিন গেল, দু-দিন গেল। ইকোয়েডরে ভয়ানক অশান্তি। রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে মন্ত্রীরা দেশের লোককে এত উসকে দিয়েছেন যে একটা অন্তর্বিপ্লব যেকোনো মুহূর্তে ঘটতে পারে। এদিকে গুয়াকুইল বন্দর যায় যায়। পেরুর আকাশ-বাহিনী অবিরাম বোমা বর্ষণ করে বন্দর প্রায় গুঁড়িয়ে ফেলেছে। ওদিকে ইকোয়েডরের সেনারা গোভানির নেতৃত্বে পাহাড়ের জঙ্গলে আগুন দিচ্ছে।
তৃতীয় দিন অধিকাংশ মন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগ পত্র দাখিল করলেন। তারা রাজ্যে নতুন নির্বাচনের পক্ষপাতী। কুইটো নগরের অবস্থা ঠিক ঝড়ের আগের আকাশের মতো। বিপ্লব আসন্ন। বিকেলবেলা সশস্ত্র একদল নাগরিক চলল রাষ্ট্রপতির প্রাসাদের দিকে। তাঁকে হয় পদত্যাগ করতে হবে নয় বন্দি হতে হবে।
নাগরিকেরা প্রাসাদের দরজায় গিয়ে হানা দিয়েছে। রাষ্ট্রপতি দেখা করবার জন্যে আসছেন শোনা গেছে। এমন সময় এ কী ব্যাপার! হঠাৎ নির্মেঘ আকাশে অকাল-সন্ধ্যা হল কেমন করে?
নাগরিকদের একজন নেতা জানলা দিয়ে তাকিয়ে বললেন, ‘হঠাৎ অন্ধকার হল কেন বুঝতে পারছি না তো!
সেই মুহূর্তে সামনের দরজা দিয়ে ঘরে ঢুকে রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘ও সাধারণ অন্ধকার নয়, সেনর। আকাশ অন্ধকার করে আমাদেরই গোপন বাহিনী চলেছে পেরুকে শিক্ষা দিতে।’
সবিস্ময়ে সবাই বলল, ‘তার মানে?’
‘তার মানে বাইরে গিয়ে দেখবেন চলুন। বলে রাষ্ট্রপতি পথ দেখিয়ে সবাইকে বাইরে নিয়ে গেলেন। তখন পশ্চিম আকাশের দিকে তাকিয়ে সমস্ত নাগরিক একেবারে অবাক! সূর্যকে একেবারে আড়াল করে কালো ঝড়ের মেঘের মতো চলেছে পঙ্গপালের বাহিনী দক্ষিণ দিকে। তাদের সম্মিলিত পাখার শব্দে সমস্ত আকাশ গমগম করছে।
সেই দিকে তাকিয়ে রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘সৈন্য দিয়ে আর আমাদের যুদ্ধ করতে হবে না। ওরাই আমাদের হয়ে সমস্ত পেরু সাতদিনে শ্মশান করে দেবে।’

রাষ্ট্রপতির কথা যে মিথ্যা নয়, ইতিহাসেই তার সাক্ষ্য আছে। পঙ্গপাল বাহিনী পেরুর ওপর দিয়ে ঠিক প্রলয়ের ঝড়ের মতোই সেবার বয়ে গিয়েছিল। ধাতু আর পাথর ছাড়া কিছুই তারা নষ্ট করতে বাকি রাখেনি বললেই হয়। প্রথম কয়েক দিন পঙ্গপালের উৎপাত সত্ত্বেও পেরু যুদ্ধ করবার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ক্রমেই তা অসম্ভব হয়ে উঠল। পঙ্গপালের রাশের ভেতর পড়ে শুধু যে এরোপ্লেন অচল হল তা নয়, ধীরে ধীরে যুদ্ধের রসদ গেল উবে! শেষকালে সমস্ত দেশে খাদ্যের টান পড়ল। তারপরেই দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। গুয়াকুইল নেবে কী, নিজের দেশ সামলাতেই তখন পেরুর প্রাণান্ত। দশ বছরে পেরু এ ধাক্কা সামলাতে পারেনি।
পৃথিবীর ইতিহাসে এমন উপায়ে যুদ্ধজয় আর কোনো দেশ করেনি। এবং এ উপায় উদ্ভাবিত হয়েছিল পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্যে ব্যাকুল এক যুবকের মাথায়। আলেপ্পো গোভানি আন্ডিজের জঙ্গলে ঘুরতে ঘুরতে পঙ্গপালের এক বিরাট উপনিবেশ দেখতে পায়। সে-উপনিবেশে তখন শিশু পঙ্গপালেরা সবে লাফিয়ে বেড়াবার মতো বড়ো হয়েছে। এই উপনিবেশ পরে দেশের এমন কাজে লাগবে, তখন অবশ্য সে তা ভাবেনি। কিন্তু পিতৃহত্যার প্রতিশোধের উপায় ভাবতে ভাবতে এই পঙ্গপাল বাহিনীকে কাজে লাগাবার কথা তার মনে আসে। উপনিবেশের উত্তরের জঙ্গলে আগুন লাগিয়ে দিয়ে পঙ্গপালকে দক্ষিণদিকে চালিয়ে দেবার কৌশলও তার উদ্ভাবন।
আপলোড: ৫/৫/২০২০

5 comments:

  1. বাহ দারুণ গল্প

    ReplyDelete
  2. ক্লাসিক প্রেমেন মিত্তির। খালি 'ডস' অনুপস্থিত গল্পে। তার জায়গায় আলেপ্পো গোভানি।

    ReplyDelete