Thursday 2 January 2020

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): গিন্নিমা (কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)


গিন্নিমা
কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়
রজায় কড়া নাড়বার শব্দ শুনে যে আধবুড়ী মানুষটা দরজা খুলল তার পরনের কাপড়ে হলুদের ছোপ। চাউনিটা কেমন যেন! মলিনাকে দেখে বলল, ‘গিন্নিমার সেবা-যত্ন করতে এসেছ, বাছা? আমি তরকারিটা চড়িয়েছি। এস তোমাকে আশীর্বাদ করছি। ভালয়-ভালয় বাড়ি যেন ফিরে যেতে পার।’
মলিনা বেশ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। এসেছে আয়ার কাজ করতে। ভালয় ভালয় কেন যে সে বাড়ি ফিরতে না পারে, কেন যে বুড়ীর আশীর্বাদ কিচ্ছু বুঝতে পারল না।
এই আধবুড়ী মানুষটা পাগলি-পাগলি ধরনের। আপন মনেই কথা কয়। রান্নাঘরে যাবার সময় আপন মনে গজ গজ করতে করতে সে বলে চলল, ‘আবার জোয়ান ছুঁড়ি... কতগুলো ছুঁড়ির সব্বনাশ হতে দেখলাম যে ... নারায়ণ, নারায়ণ, মেয়েটা যেন বাঁচে.... ঢলঢলেপানা মুখটা... আমার সেই মেয়েটার মত ... নারায়ণ, নারায়ণ ... মেয়েটা যেন ...
রান্নাঘরে তারপর থেকেই বুড়ী কাজের মানুষ।
তরকারি সাঁতলে মলিনাকে বলল, ‘খুব সাবধান। প্লেট-টেলেটে যেন কিছু না পড়ে। ইদিক-উদিক হলেই গিন্নিমা তুলকালাম করবে।’
প্লেটে খাবার সাজিয়ে দোতলায় গিন্নিমার ঘরের ভেজান দরজার সামনে পৌঁছে মলিনার বুকের ভিতরটা দুরদুর করে উঠল। কেন যে হাত পা শির শির করতে লাগল সে বুঝল না। আয়ার কাজ সে নতুন করছে না। প্রায় পাঁচ বছর হল করছে। মিলনের সঙ্গে বিয়ের পর থেকেই। নইলে সংসার চলে না। কিন্তু এমনটা তো কই আগে কখনো হয়নি। ভয়ডর নেই বলে তার বেশ গর্ব ছিল। কিন্তু আজ এ কী ব্যাপার? নিজের উপর সে বিরক্ত হল।
তারপর বেশ সন্তর্পণে হাঁটু দিয়ে ভেজানো দরজাটা খুলে সে ঘরের ভিতরে গেল। রাস্তার দিকে দক্ষিণের জানালার একটা পাটি খোলা। আর সব জানালা বন্ধ। ঘরটায় তাই আবছা আলো। খাটটা জানালা থেকে হাত খানেক দূরে। পর-পর তিনটে বালিশে মাথা রেখে গিন্নিমা শুয়ে। শীতকাল, তাই গিন্নিমার শরীর লেপে ঢাকা। শুধু দুটো হাত আর মুখ বেরিয়ে আছে। লেপ-ঢাকা শরীর ছোটখাটো পাহাড়ের মত। আর হাত তো নয়, যেন হাতির পা। ঝুলে-পড়া গাল দুটোর মধ্যে কত স্তর যে মেদ জমেছে কে জানে। মনে হয় তার শরীরে থলথলে মেদের নীচে হাড়গোড় বলে কিছু নেই।
কিন্তু চোখ দুটো অসম্ভব তীক্ষ্ণ। চোখে চোখ পড়লে বুকের ভিতরটা হিম হয়ে আসে। সাপের চোখের মত। এরকম নিষ্ঠুর চাউনি, এরকম মোটা শরীর জীবনে মলিনা দেখেনি।
সে শুনেছিল পঞ্চান্ন বছর ধরে পক্ষাঘাতে গিন্নিমা বিছানায় শুয়ে। পঞ্চান্ন বছর হাঁটা-চলা নেই। তাই বেজায় মোটা হয়ে পড়েছেন। কোনদিন এ রকম মানুষের মুখোমুখি যে হতে হবে মলিনার কল্পনাতেই ছিল না।
কুতকুতে চোখ দুটির তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মলিনাকে বিঁধে বাঁজখাই স্বরে গিন্নিমা বললেন, ‘তুই তা হলে নতুন ছুঁড়ি, আয়ার কাজ করতে এসেছিস? বেশ বেশ। পাশের টেবিলে ট্রে টা নামা। কাছে আয়। ভাল করে দেখি।’
ট্রে নামিয়ে খাটের পাশে দাঁড়িয়ে গিন্নিমার চোখ দুটোর দিকে আবার তাকাতেই মলিনার মাথার মধ্যে সবকিছু যেন উলটো পালটা হয়ে গেল। মনে হল তার শরীরের মধ্যে দিয়ে যেন কারেন্ট বয়ে যাচ্ছে। মনে হল সে যেন ডুবতে বসেছে। তার শরীরটা যেন গলে যাচ্ছে। মনে হল, এই ঘরটা যেন নেই, খাট-চেয়ার-টেবিল-আলমারি কিচ্ছু নেই। গিন্নিমাও যেন নেই। আছে শুধু কুতকুতে দুটো চোখ আর ভয়ঙ্কর নিষ্ঠুর একটা চাউনি। আর কিছু নয়...
কিন্তু সেটা মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল ঘর, চেয়ার টেবিল-খাট-আলমারি আর গিন্নিমার ঢাউস শরীরটা।
গিন্নিমা চোখ বুঁজে বলে চললেন, ‘তোর বয়েসটা বেশ কাঁচা দেখছি। বাইশ-তেইশের বেশি নয়। শরীরটা মজবুত আর বেশ পুরন্তও। তবে রূপের জেল্লা কম। তোর বয়সে আমি ছিলাম—যাকে বলে ডানা কাটা পরী। একমাথা ঘন চুল, মাখনের মত গায়ের চামড়া। ছিপছিপে শরীর। কোমরটা তোর মত ভারী নয়। কত ছোঁড়ার যে মাথা ঘুরিয়ে দিতাম। কত ছোঁড়া যে আমার সঙ্গে প্রেম করার জন্যে হন্যে হয়ে ঘুরত, যদি জানতিস—কিন্তু আজ? পঞ্চান্ন বছর ধরে বিছানায় পড়ে। পঞ্চান্ন বছর মেঝেয় পা দিইনি। কিন্তু সে দিনগুলোর কথা ভুলিনি। যখন রূপসী ছিলাম, যখন জোয়ান ছিলাম, যখন যৌবন ছিল।
গিন্নিমার কথা শুনে তার জন্য মলিনার কিন্তু বিন্দুমাত্র করুণা হল না। তার শরীরের অবশ ভাবটা আর নেই। কিন্তু তার বদলে মাথার মধ্যে হঠাৎ শুরু হয়েছে অসহ্য একটা যন্ত্রণা। মাথার মধ্যেকার দপদপ যেন কানের মধ্যে ধাক্কা দিচ্ছে। মলিনা তখন ঘর থেকে এক দৌড়ে একতলার রান্নাঘরে আধবুড়ী মানুষটার কাছে পালাতে পারলে বাঁচে।
হঠাৎ সুর পালটে গিন্নিমা বলে উঠলেন, ‘এই ছুঁড়ি, জবুথবু হয়ে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বালিশগুলো একটু উঁচু করে দে। নইলে খাব কী করে?’
মলিনা মাথার বালিশগুলো ঠিকঠাক করছে এমন সময় গিন্নিমা আচমকা তার ডান হাতের কবজিটা চেপে ধরলেন।
উঃ! এই মেদবহুল থলথলে হাত দুটোর মধ্যে এমন প্রচণ্ড শক্তির কথা কে কল্পনা করতে পেরেছিল? গিন্নিমার ঠোঁটে একটা ধূর্ত হাসি ফুটে উঠল। তারপর অন্য হাত দিয়ে মলিনার কনুই থেকে কাঁধ পর্যন্ত হাত বোলাতে লাগলেন। একবার আলতোভাবে চিমটি কাটলেন।
হাত বোলাতে বোলাতে গিন্নিমা বলে চললেন, ‘তুই ভেবেছিলি আমি একটা থলথলে বুড়ী? মোটেই নয়। শুধু খাবারে আমার তৃপ্তি নেই। জোয়ান বয়সের দিনগুলোর কথা একটুও ভুলিনি। জোয়ান বয়সের গা শিউরানো আয়েসগুলোর কথা। ভেবেছিস বুঝি ডবকা ছুঁড়ি বলে একাই সেগুলো ভোগ করবি! তাই না? তোর সিঁথিতে সিঁদুর দেখছি। নিশ্চয়ই বিয়ে হয়েছে। বরটা কেমন রে? তোর বরের গল্প কর না একটু। ছোকরা লম্বা? জোয়ান? কী রকম জোয়ান রে? তোর ঢলঢলে শরীর দেখে তো মনে হচ্ছে রোজ রোজ প্রেম করে? রাতে কবার করে প্রেম করে রে? খুব তাগড়া চেহারা? কেমন করে প্রেম করে রে? কেমন করে—’
মরিয়া হয়ে এক ঝটকায় মলিনা তার হাত ছাড়িয়ে নিল। সঙ্গে সঙ্গে গিন্নিমার স্বর থেমে গেল। চোখের পাতা বুজে এল। তারপর ফাঁকা চোখে তাকিয়ে ট্রের দিকে থলথলে হাতটা তিনি বাড়ালেন।
রান্নাঘরে সে যখন পৌঁছল সর্বাঙ্গ তার থরথর করছে। গা গুলিয়ে গুলিয়ে উঠছে। কী ঘিনঘিনে মন! কী জঘন্য মন! তার ইচ্ছে করছিল সবকিছু আছড়ে আছড়ে ভাঙতে।
বালতি থেকে মগ মগ জল তুলে দু হাতে হুড় হুড় করে সে ঢালতে লাগল।
আধবুড়ী মানুষটা তার দিকে সামান্য অবাক হয়ে তাকিয়ে বলে চলল, ‘এর মধ্যেই গিন্নিমার সঙ্গে খিটিমিটি বাধিয়েছ বাছা? মানুষটার সঙ্গে মানিয়ে চলা খুবই যে কঠিন সে কথা মানছি। তবে পরের বাড়িতে চাকরি করতে গেলে অনেক কিছু সইতে হয়। তাই খুব সমঝে চল। কত মেয়েকেই যে আসতে যেতে দেখলাম আয়ার কাজ করতে! কেউই টিকতে পারে না। সত্যি কথাটা বলেই ফেলি। গিন্নিমার মেজাজের দরুন সেই যে শ্রাবণ মাসে আয়া মেয়েটা বাড়ি থেকে পালালো, আজ মাঘ মাসের অমাবস্যে এর মধ্যে আয়ার কাজের জন্যে কাউকে জোগাড় করতে পারিনি। এ কটা মাস খেটে খেটে আমার হাড় কালি হয়ে গেছে। এর মধ্যে আমার মত দুটো আধবুড়ী আয়ার জোগাড় করেছিলাম। গিন্নিমা তাদের দূর দূর করে তাড়াল। আধবুড়ী গিন্নিমার দুচোখের বিষ। চায় জোয়ান-জোয়ান ছুঁড়ি। রোজ রোজ কোথা ছুঁড়ি ধরি বল তো বাছা? আর ছুঁড়িদের যেমন স্বভাব। কটা দিন কাটতে না কাটতেই গিন্নিমার ঘর থেকে বেরিয়ে তাকে নকল করতে শুরু করে দেয়! আমাকে গেরাজ্যি করে না। গিন্নিমার মত হাত নাড়ে, গিন্নি মার মত চোখ ক্ষুদি ক্ষুদি করে কেমনতর যেন তাকায়, চোখ ঘোরায়। একটা তো গিন্নিমার গলার স্বর অবিকল নকল করতে শুরু করেছিল। দেখে শুনে তো গায়ে কাঁটা দিত। বুকের রক্ত হিম হয়ে আসত। মেয়েটা তোমার বয়িসী ছিল। মাসখানেক টিকেছিল। তারপর এক ভোরে বাগানের আমগাছটায় গলায় দড়ি দিয়ে মরে। কেন যে গলায় দড়ি দেয় আজ পর্যন্ত কেউ তার হদিস করতে পারেনি। সে এক দারুণ হুজ্জত। দারোগা পুলিশে বাড়ি গিসগিস। হদিশ করতে পারেনি।’
মলিনার দুই চোখ দিয়ে তখন অঝোরে জল ঝরছিল। সেদিকে তাকিয়ে আধবুড়ী মানুষটা বলে চলল, ‘কেঁদো না বাছা, কেঁদো না। বুড়ী মানুষ। মাথার কি আর ঠিক আছে? ভীমরতি ধরেছে যে। যা বলে তা কি আর ভেবে চিন্তে বলে? তার কথায় কান দিয়ো না। মুখটি বুঁজে কাজ করে যেয়ো। আর একটা কথা বাছা ওই সব ধিঙ্গি ছুঁড়িদের মতো গিন্নিমাকে আড়ালে আবডালে কখনো ভেংচি কেটো না।’
কিন্তু বেলা যত বাড়তে লাগল মলিনার মাথার যন্ত্রণাটাও বাড়তে লাগল তত। তার সঙ্গে অন্যমনস্কও হয়ে উঠতে লাগলো। পদে-পদে কাজে তার ভুল হতে লাগল। পেঁয়াজ কুচোতে গিয়ে বুড়ো আঙ্গুল কাটল। হাত থেকে পড়ে চাটনির পাথরের বাটিটা চুরমার।
বেজায় বেজার হয়ে বুড়ী মানুষটা বলল, ‘হাত পায়ে যে বশ নেই বাছা। বলি মনটা কোথায় পড়ে আছে গো? বরের কাছে? খুব আদর করে বুঝি?’
দুপুরের খাবার ট্রে–তে সাজিয়ে মলিনা গিন্নিমার কাছে গেল। হাত-পা তখন বেজায় কাঁপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। মাথার অসহ্য যন্ত্রণা। কিন্তু গিন্নিমা তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। একটি কথাও কইলেন না।
মলিনা রান্নাঘরে ফিরে গেল। কাঁপা হাতে বাসনপত্র ধুলো। কোনও মতে নাকে মুখে কিছু গুঁজল। আর কেবল ভাবতে লাগল সাড়ে সাতটা কখন বাজবে? কখন তার বরের ছুটি হবে? কারখানায় ডিউটি সেরে মিলন তাকে কখন নিয়ে যেতে আসবে তার স্কুটারে? ... মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে.. মিলন—মিলন, কখন তুমি আসবে?... মিলন—মিলন....
বুড়ী মানুষটার কাছ থেকে রাতের খাবারের ট্রে নিয়ে গিন্নিমার ঘরে মলিনা যখন ঢুকল তখন সে মনস্থির করে ফেলেছে। গিন্নিমা যদি আগের মতো তার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে নির্বিঘ্নে কথাগুলো বলেন, তাহলে সে আর ছেড়ে কথা বলবে না। নখ দিয়ে ফালি ফালি করে ফেলবে থলথলে মুখটা। গেলে দেবে তার সাপের মত ক্রুর চোখ দুটো।
উঃ, কিন্তু কী হয়েছে তার? এ রকম ভাবনা কখনো তো তার মাথায় আসেনি। আর মাথা— মাথায় তার এমন যন্ত্রণা আর তো কখনো হয় নি!
কিন্তু কী আশ্চর্য! এবারও গিন্নি মা তার দিকে ফিরেও তাকালেন না। একটি কথাও কইলেন না। মলিনা রান্নাঘরে ফিরে কাচের বাসনগুলো ধুলো। তারপর নিজের মুখ হাত পরিষ্কার করে পুরোনো হাতব্যাগ থেকে সিঁদুর কৌটো বার করে কপালে পরল বেশ বড়সড় লাল একটা টিপ।
এমন সময় দরজায় সামনে শোনা গেল মিলনের স্কুটারের চাপা হর্ন। স্কুটারে সে কারখানায় যাতায়াত করে। ঠিক ছিল ফিরতি পথে এসে সে হর্ন দেবে। তারপর মলিনাকে পিছনে বসিয়ে বাড়ি ফিরবে।
এমন সময় আধবুড়ী মানুষটা গিন্নিমার ঘর থেকে রান্নাঘরে ফিরে মলিনাকে বলল, যাও বাছা, গিন্নিমার সঙ্গে দেখা করে যাও। গিন্নিমা বলে দিয়েছেন। তোমার বর এসে গেছে দেখছি। তাকে গিয়ে বলছি দু মিনিট সবুর করতে।
অসহায় চোখে বুড়ী মানুষটার দিকে তাকিয়ে মলিনা আবার গেল দোতলায় গিন্নিমার ঘরে।
গলায় মধু ঢেলে গিন্নিমা বললেন, ‘তোর বর এসে গেছে তাই না? জানলা দিয়ে তাকে স্কুটারে বসে অধৈর্য হয়ে হর্ন দিতে দেখছি।
মলিনা বলল, ‘হ্যাঁ গিন্নি মা।’
আবার গলায় মধু ঢেলে গিন্নিমা বললেন, ‘বেশ, বেশ। বাড়ি যাবি বৈকি বাছা। —বরের স্কুটারের পেছনে বসে, তাকে সাপটে ধরে। তোকে আর ধরে রাখব না। এবার আমি ঘুমোব। শুধু যাবার আগে মাথার তলা থেকে একটা বালিশ সরিয়ে দিয়ে যা।’
তখনি মলিনার সাবধান হওয়া উচিত ছিল। উচিত ছিল ঘর থেকে দৌড়ে পালানো। উচিত ছিল সেই সর্বনেশে হাত দুটোর নাগালের মধ্যে না যাওয়া। কিন্তু গিন্নিমার মধু ঝরা স্বরে তার মন খানিকটা ভিজেছিল।
বিছানার কাছে গিয়ে গিন্নিমার মাথার তলা থেকে একটা বালিশ সে সরালো আর বিদ্যুতের মত সেই সাঁড়াশি-শক্ত একটা হাত বজ্র মুঠোয় মলিনার একটা কবজি ধরে তাকে নিজের কাছে টেনে আনল।
মলিনার গলা তখন শুকিয়ে কাঠ। যন্ত্রণায় মাথাটা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। আর গিন্নিমা সাপের মত হিসহিস করে বলে চলেছেন, ‘নারে ছুঁড়ি, স্কুটারের পিছনে বসে বরকে সাপটে ধরে তোর আর বাড়ি ফেরা হবে না। জোয়ান বরটার সঙ্গে রাতে বার কয়েক করে শিউরে শিউরে উঠে প্রেম করা হবে না তোর। জীবনেও নয়। তুই যে আর মলিনা নোস, কী করে জানবে তোর তাগড়া বর? ভাববে তার জোয়ান ছুঁড়ি ডবকা বউ আরও জোয়ান হয়েছে! কী খুশি সে যে হবে তখন....!
মনে হল গিন্নিমা যেন কথা কইছেন না। কথা কইছে সাপের মত তার ক্রুর চোখ দুটো। দেখতে দেখতে ঘরের আবছা আলো আরও আবছা হয়ে উঠল। সেই ক্রুর চোখ দুটো কয়লাখাদের মত নিকস কালো হয়ে গেল। কালো আর গভীর। তারপর দুটো চোখ যেন এক হয়ে গিয়ে অমাবস্যার রাত হল। আর মলিনা সেখানে ডুবতে লাগল, ডুবতে লাগল...
ঘরটা বেজায় স্তব্ধ।
মলিনার মাথার মধ্যে আর যন্ত্রণা নেই। সর্বাঙ্গে শুধু একটা ঝিমঝিমে অবসাদ। সেই অবসাদ ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ল তার উরুতে, তার পায়ে, তার পায়ের গোছে। পা দুটো তার কী মোটা হয়ে গেছে! লেপের তলায় ছড়িয়ে রয়েছে। সাড় নেই কোন পায়েই।
নিজেকে দেখতে লাগল মলিনা। বিছানা ছেড়ে সে উঠল। কোমরের কশি আঁট করল। ঠিক করে নিল শাড়ি। আঁচল। বড় আয়নায় নিজেকে দেখে মুখ টিপে হাসল। তারপর দরজা খুলে বেরিয়ে গেল। শুনতে পেল সিঁড়িতে তার চটি পরা পায়ের চটপট শব্দ।
এই প্রথম মলিনা টের পেল পঞ্চান্ন বছর ধরে সে হাঁটেনি। জীবনে কোনদিন সে হাঁটতে পারবে না।
দুটো হাত তার নিশপিশ করতে লাগল। কী আশ্চর্য হাত দুটোয় তার কী আশ্চর্য ক্ষমতা!
জানালা দিয়ে সে দেখল মিলনের স্কুটারের পিছনের সিটে বসে তাকে সে সাপটে ধরেছে।
মিলনের গলা তার কানে এল, ‘এত দেরি কেন?’
নিজের স্বর সে শুনতে পেল, ‘গিন্নিমা মাথার বালিশটা সরাতে ডেকেছিলেন।’
আপলোড: ২৫/৪/২০২০

3 comments: