Thursday 2 January 2020

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃ ভাঃ): রাতের আশ্রয় (মনোজ বসু)


রাতের আশ্রয়।
মনোজ বসু
রাত দুপুরে মোটরবাস রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দিয়ে গেল। গাঁ-বসতি নেই কোনোদিকে। আউশ-খেতের মধ্যে দিয়ে কাঁচারাস্তা চলে গেছে। দুর্যোগও বিষম। হু-হু করে হাওয়া বইছে রাস্তা থেকে উড়িয়ে ধানবনে ফেলে না দেয়। ক্ষণে ক্ষণে বৃষ্টি। অন্ধকারে চারদিক লেপেপুঁছে গেছে। এক মাত্র সুবিধা, ঝিলিক দিচ্ছে মাঝে মাঝে। সেই আলোয় পথ দেখে এগুচ্ছি।
অথচ কোনো গোলমাল হবার কথা নয়। সন্ধ্যা নাগাদ বাস নামিয়ে দেবে, পালকি থাকবে। বাস থেকে নেমেই পালকি।—এই সমস্ত লিখেছিল দীপেশ। বি ডি অর্থাৎ ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসে কাজ করে সে। মাইল তিনেক পথ। কাঁচারাস্তা বটে, কিন্তু বাঁকাচুর নেই, নাকের সোজা চলে গেছে। অন্ধ মানুষও অবাধে চলে যেতে পারে। আর, আমার জন্যে তো পালকি।—দীপেশ সবিস্তারে সমস্ত জানিয়েছিল।
কিন্তু বাসটা বদমায়েশি করল। গোড়ায় বেশ ভালো। অ্যাসিস্ট্যান্ট বার পাঁচ-সাত হ্যান্ডেল মারতে গর্জন করে উঠল। ড্রাইভার গদি থেকে নেমে এসে ইঞ্জিনের সামনে পথের উপর গড় হয়ে প্রণাম করল। ভাবখানা এই, ত্যাঁদড়ামি কোরো না আজকের এই দুর্যোগের দিনে, এক দৌড়ে গিয়ে কেশবপুর থানার সামনে নিজের জায়গায় দাঁড়াও, রাতের মতন নিশ্চিন্ত। বাসও যেন কানে নিল কথাটা। ভক্‌ভক্ আওয়াজ করে পথের গরুছাগল মানুষজন ভয় দেখিয়ে দিব্যি স্ফূর্তিভরে দৌড়চ্ছে। কুয়োদার হাট ছাড়িয়ে এসে মাথায় যে কী শয়তানি ভর করল—একেবারে নিঃশ্চুপ। অনড় হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। কত কাণ্ড করছে ড্রাইভার—এটা খুলছে, ওটা খুলছে, ইঞ্জিনের তলায় ঢুকে যাচ্ছে এক-একবার। কিছুতেই কিছু নয়। শেষটা নিজের সিটে উঠে বসে যত প্যাসেঞ্জার নামিয়ে দিল। বলে, ঠেলুন মশয়রা…
পঁচিশজনের পঞ্চাশখানা হাত ঠেললে তো গাড়িও চলতে লাগল। ঠেলা বন্ধ হল তো গাড়িও অচল। বৃষ্টি-বাদলার মধ্যে গাড়ি যেন নেশা করে বুঁদ হয়ে আছে, আমরা ঠেলে নিয়ে যাচ্ছি।
প্যাসেঞ্জাররা চেঁচামেচি করে, এ বেশ মজার হল। ঠেলতে ঠেলতে কেশবপুর পৌঁছে দিতে হবে নাকি? ভাড়া নিয়েছ তবে কেন?
ড্রাইভার বলে, বেশ, সিটে উঠে পড়ুন তবে মশায়রা। তাতে যদি গাড়ি কেশবপুর পৌঁছে দেয়, আমার কোন ক্ষতি?
না তোমার ক্ষতি কোনোদিকে নয়। গাড়ি না চলে তো আমরা ঠেলব, চললে তখন তো ইঞ্জিনেই টানছে। তুমি থাক আরাম করে গদির উপরে।
আজেবাজে কথার জবাব না দিয়ে ড্রাইভার নির্বিকারে বিড়ি ধরাল একটা। আমাদের কষ্টে ও কাকুতিমিনতিতে শেষটা বুঝি ইঞ্জিনের দয়া হল খানিকটা। আওয়াজ দিয়ে উঠল হঠাৎ। চলতেও শুরু করল। কিন্তু খানিকটা গিয়ে ঝিমিয়ে আসে আবার, দাঁড়িয়ে পড়ে। পুনশ্চ ধস্তাধস্তি। এমনি ভাবে যেখানে ঠিক সন্ধ্যার সময়ে এসে পৌঁছবার কথা, সেখানে রাত্রি বারোটায় এনে নামিয়ে দিল।
দিয়েই ছুট। ড্রাইভার বলে, দেরি করতে গেলে আবার হয়তো বিগড়ে যাবে, তাহলে চিওির। নামবার সময়টুকুও দেয় না এমনি অবস্থা।
ছুটে বেরুল মোটরবাস। নীরব অন্ধকার। ছরছর করে এই সময় বৃষ্টি এল এক পশলা। কাঁচারাস্তার জলকাদা ভেঙে চলেছি। বিপদের উপর বিপদ—মাঠের উলটোপালটা হাওয়া ছাতায় বেঁধে পটপট করে কতকগুলো শিক ভেঙে গেল, ছাতার কাপড় উড়ছে ঘুড়ির মতন পতপত করে। তখন আর চলা নয়—দৌড়ানো দস্তুরমতো। তেপান্তর মাঠ থেকে ছুটে পালিয়ে গা-বসতি কোথাও আশ্রয় পেতে চাই।
ছুটছি, ছুটছি। নদীর উপর এলাম। নদীর কথাও দীপেশ লিখেছিল বটে। নদীর উপরে পাকা পুলের কথা। পথ ভুল করিনি তবে। কিন্তু আর তো পেরে উঠিনে। শীত ধরে গিয়ে সর্বাঙ্গ ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছে, পা চলতে চাইছে না। অসাড় হয়ে পথের উপর পড়ে না যাই, এই এখন ভয়।
ঝিলিক দিল একবার। দেখলাম, পুলটা ছাড়িয়ে অদূরে অশ্বথতলায় পাকাঘর। চুনকাম-করা শাদা দেয়াল বিদ্যুতের আলোয় ঝিকমিক করে উঠল। খেতে চাই নে। জায়গার অকুলান থাকে তো এমনকী শোওয়ার কথা বলব না। রাতটুকু মাথা গুঁজে থাকবার মতো আশ্রয়।
কড়া নাড়তে সঙ্গে সঙ্গে দরজা খুলে গেল। এমন নিশিরাত্রে জেগেই ছিল ভিতরের মানুষ। মাথায় আধ-ঘোমটা ফুটফুটে এক তরুণী বউ দরজা খুলে দিল।
পিছনে এক বুড়ো মানুষ। বিদ্যুৎ চমকাল ঠিক এই সময়। দেখলাম, কাঁদছিল বউটা। এখনো সামলে নিতে পারেনি। কেঁদে কেঁদে চোখ লাল। দু-গালে জলের ধারা গড়াচ্ছে। কোন দুঃখে জানি নে, ঘরে খিল এঁটে বসে কাঁদছিল. বুড়োর সঙ্গেই বা কি সম্পর্ক বউটার—
বুড়ো পরিচয় দিয়ে দিলেন,আমার বউমা। দাঁড়িয়ে কেন বাবা, ভিতরে এসো। বৃষ্টিতে নেয়ে গেছ একেবারে। শুকনো কাপড়চোপড় আছে তো সঙ্গে?
হাতের কিটব্যাগ দেখিয়ে দিলাম। মোটামুটি সমস্ত আছে। বুড়ো বললেন,-বউমা, বসবার একটা কিছু পেতে দাও খাটের উপর। বাছার বড় কষ্ট হয়েছে।
কী মোলায়েম কথা বুড়োমানুষটির। কথা শুনে সব কষ্ট জুড়িয়ে যায়। চেহারাটিও মুনিঋষির মতন। বউটি বলবার আগেই বেরিয়ে চলে গেছে। ব্যাগ খুলে শুকনো কাপড় বের করে পরলাম। মাদুর বালিশ আর চাদর হাতে করে বউ ফিরে এল, পরিপাটি করে পেতে দিল। যেমন শ্বশুর, তেমনি বউ-কী ভালো যে এরা! কিন্তু বড় দরিদ্র। নড়বড়ে ছোট একখানা খাট একেবারে খালি পড়েছিল। মাদুর বালিশ চাদরে বিছানা করছে তা-ও অতি জীর্ণ। চুপিচুপি বলছি, দোষ নেবেন না— সাধারণ অবস্থায় অমন চাদরে পা মুছি নে আমরা।
বিছানা করে দিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি বললাম, রাত দুপুরে রাঁধাবাড়ার হাঙ্গামায় যাবেন না আবার। মণিরামপুরে গাড়ি অচল হয়েছিল, সে সময়টা ভরপেট খেয়ে নিয়েছি।
বউটি বড় বড় চোখ মেলে আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেল। বুড়ো দেখছি মজলিশি মানুষ। এত রাত্রি, তবু খাটের প্রান্তে পা ঝুলিয়ে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন।
—একেবারে কিছু খাবে না বাবা? না, লজ্জা করে বলছ? ছেলের মতো তুমি, খুলেই বলি। দুর্যোগে অতিথি হয়ে এলে। সত্যি ভাবনা হয়েছিল, কি খেতে দিই এখন। বউমার মনে ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তবু সে মেয়ে বড্ড ভালো। তুমি নিজে থেকে মানা না করলে এতক্ষণে রান্নাবান্না বসিয়ে দিত।
সুযোগ পেয়ে জিজ্ঞাসা করি, কাঁদছিলেন যেন উনি? কি হয়েছে।
ফোঁস করে বুড়ো এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেললেন, বড় দুঃখের বৃত্তান্ত। সংসারে আগুন ধরে গেল। রোজগেরে ছেলে বাসা থেকে দূর করে দিল আমাদের। আগে বউমাকে দিল, তার পর আমাকে। একটা বেলার এদিক-ওদিক। বাপবেটি সেই থেকে এখানে আশ্রয় নিয়ে আছি। ছেলে আবার বিয়ে করছে শুনতে পেলাম। বউমা ছেলেমানুষ তো-খবর শোনা অবধি দু-চোখে ধারা বয়ে যাচ্ছে তার।
স্তম্ভিত হয়ে গেছি। বুড়ো আরো কত কি বলে যাচ্ছেন, এক বর্ণ আমার কানে যাচ্ছে না। নিরপরাধ এই সুন্দরী মেয়েটাকে ত্যাগ করেছে। এবং বাপ বোধ হয় পুত্রবধূর হয়ে দু-কথা বলতে গিয়েছিলেন, সেজন্য তাকেও তাড়িয়েছে। সেই পাষণ্ড টোপর মাথায় দিয়ে আবার নতুন বউ আনতে চলল। হাতের মাথায় পেলে লোকটাকে সমুচিত শিক্ষা দিয়ে দিতাম, তাতে আমার জেল-ফাঁসি যা হবার যত। এই সমস্ত ভাবছি। এক সময় বুড়ো উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, দরজা দিয়ে শুয়ে পড় বাবা। আমরা এই পাশেই রইলাম।
জোর বৃষ্টি-বাতাস তখনো বাইরে। বড্ড ধকল গিয়েছে, শুতে শুতেই ঘুমিয়ে পড়েছি। মড়ার মতন ঘুমিয়েছি। যখন ঘুম ভাঙল, দরজা খুলে দেখি, বিস্তর বেলা হয়েছে। চারিদিকে রোদ, রাত্রিবেলায় অত দুর্যোগের চিহ্নমাত্র নেই।
চলে যাওয়ার আগে বুড়ো মানুষটিকে দু-এক কথা বলে যাওয়া উচিত। বড় ভালো লোক এরা। আরে সর্বনাশ, এ কোন জায়গা, ঘরের ঠিক পিছনে শ্মশান-ঘাট মজা-নদীর কূলে। আধপোড়া কাঠ, ভাঙা কলসী, ছেড়া মাদুর-বালিশ ইতস্তত ছড়ানো, গ্রাম্য শ্মশানের যে চেহারা হামেশাই দেখা যায়। যে কুঠুরিতে রাত্রিবাস করেছি, সেটা শ্মশানবন্ধুদের বসা-ওঠার জায়গা। দেয়ালে সাল তারিখ সব খোদাই করা আছে, রাত্রিবেলা নজরে আসেনি। নবীনচন্দ্র মালাকার নামে কোন এক ব্যবসায়ী পিতামাতার আত্মার কল্যাণে এই ঘর বছরখানেক আগে বানিয়ে দিয়েছেন। আমার শোবার ব্যবস্থা করে দিয়ে শ্বশুর আর পুত্রবধূ গেলেন কোথায় তবে?
ঘণ্টাখানেক পরে বি ডি অফিসে হাজির হলাম। অদূরে দীপেশের কোয়ার্টার। ইস্কুলে পড়বার সময় দীপেশ অভিন্নহৃদয় বন্ধু ছিল আমার। অনেক বছর পরে হঠাৎ এই সেদিন শিয়ালদা স্টেশনে দেখা। বিয়ের বাজার করে ফিরছে। আমায় নিমন্ত্রণ করে হাত দুটো জড়িয়ে ধরে বারংবার যাবার জন্য বলল। কথা না দিয়ে পারলাম না। সেই কথা রাখতে গিয়ে এত দুর্ভোগ।
আমায় দেখে দীপেশ কলরব করে উঠল। বিয়ের তারিখ কাল। আত্মীয়স্বজন কিছু কিছু এসে পড়েছেন। ভিড় জমেছে মন্দ নয়। বলে, এক-গলা কথা জমে আছে, চল। চেঁচিয়ে চা-খাবার দিতে বলে টানতে টানতে তার নিজের ঘরখানায় নিয়ে চলল।
ঘরে ঢুকে চমকে উঠি। সামনের দেয়ালে হাসিমুখ তরুণীর ছবি। ঠিক তার উলটোদিকের দেয়ালে বুড়ো মানুষটি। কাল রাত্রে শ্বশুর আর পুত্রবধূ সেই যে দুজনকে দেখেছিলাম। স্তম্ভিত বিস্ময়ে দীপেশটাকে জিজ্ঞাসা করি, ছবি কাদের?
আমার স্ত্রী নীরা। আর ইনি হলেন বাবা। দীপেশের চোখ ছলছল করে ওঠে, এই কোয়ার্টারে আসার পরেই সর্বনাশ হল। কলেরা হয়ে দুজনে মারা গেলেন। একই দিনে। সকাল আর বিকাল। আটমাস হয়ে গেল দেখতে দেখতে। বউমা বলতে বাবা অজ্ঞান হতেন। বউ যেতে তাই যেন তিনি আর দেরি করলেন না।
আপলোড: ২২/৩/২০২০

6 comments:

  1. যদিও ভূতুড়ে, তবুও বলব গভীর উপলব্ধির গল্প। খুব ভালো লাগল !!!!!!!!!!!!

    ReplyDelete
  2. Ki apurbo, bhari sundor laglo. Ashonkhyo dhonnobad

    ReplyDelete
  3. Ashonkhyo dhonnobad, Apurbo golpo ti post korar jonno.

    ReplyDelete
  4. Dipesh Babu sotti kotha bolchhen to ?

    ReplyDelete