Saturday 3 January 2015

ভ্রমণকথা (মোবাইল ভার্শন): ছোট রেলে দার্জিলিং (শিশির বিশ্বাস)


মে মাসের দারুণ গরমে সবার প্রাণ যখন আইঢাই জলের বোতল আর হাতপাখায় ব্যস্ত দার্জিলিংয়ের পথে আমাদের খুদে রেলগাড়ির তখন বিশ্রাম নেই একদম নাগাড়ে উঃআঃ উঃআঃ শব্দে শুখনা পার হয়ে চা বাগানের পাশ দিয়ে চলতে চলতে কখন যে পাহাড় দেশের পেটের ভিতর ঢুকে পড়েছে ধরতেই পারল না কেউ!
অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি‚ দুধারে সমতলের কোনো চিহ্নই আর নেই তো! শুধু বনজঙ্গলে ঘেরা পাহাড় দেশ পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে পথ চলেছে খুদে রেলগাড়ি একে একে পার হয়ে গেল রংটং আর চুনাভাটি পথের পাশে পাহাড়ের দেয়াল এই দেখি বাঁ দিকে তো একটু পরেই চলে আসে ডান দিকে পাহাড়ি ম্যাজিক দেখাতে দেখাতে গাড়ি ওঠে আরও উঁচুতে 
তাকিয়ে দেখি‚ নীচে পাহাড়ি পথে হেলতে দুলতে উঠছে রঙিন পোষাক পরা দুই পাহাড়ি মেয়ে পিঠে মস্ত ঝুড়িতে কাঠকুটো চলেছে অনেক উঁচুতে এক পাহাড়ি গ্রামের দিকে হঠাৎ এক কাঠবেড়ালির ছানা ঝোপের আড়াল থেকে বের হয়ে সামনে রেলগাড়ি দেখে বেজায় ঘাবড়ে লেজ তুলে দৌড় দিল পাইন গাছের দিকে তড়বড়িয়ে গুঁড়ি বেয়ে একদম ডগায় গরগর শব্দে পিছন থেকে একটা বাস টপকে চলে যায় খুদে রেলগাড়িকে বাসের জানলা দিয়ে মিষ্টি হেসে হাত নাড়ে মাথায় রঙিন রিবন ছোট্ট মেয়েটি‚ টাটা
খুদে রেলগাড়িটা পিটপিট করে তাকিয়ে বলে‚ আসছিআসছি
কিন্তু বাস বাবাজি তেজি ঘোড়ার বেগে হারিয়ে যায় পাহাড়ের বাঁকে রেলগাড়ি তার নাগালই পায় না পথের পাশে দুই পাহাড়ি খুদে তাই দেখে হেসে কুটিপাটি।
ওদিকে চা বাগানে ভোঁ পড়েছে। দল বেঁধে ঝুড়ি মাথায় মেয়েরা চলেছে বাগানের দিকে। কোথাও চা বাগানে কাজ করছে মেয়েরা। পটাপট পাতা তুলে মাথা টপকে ছুঁড়ে দিচ্ছে পিঠের মস্ত ঝুড়িতে। ঝুড়ি ভরে উঠলেই ছুটবে পাতা জমা করতে। 
চোখ ভরে দেখতে দেখতে হঠাৎ কানে আসে ঝরঝর শব্দ অদূরে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমেছে ছোট এক ঝরনা বড় বড় পাথরের ফাঁকে রুপোর পাতের মতো বয়ে চলেছে জলধারা ক্লান্ত রেলগাড়ি হাঁপাতে হাঁপাতে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানে অনেক উঁচুতে ঠিক মাথার উপর তিনধরিয়া স্টেশন নীচ থেকে মনে হয়‚ আকাশ ছুঁয়ে বসে আছেন যেন ঘনঘন হাঁশফাঁশ শব্দে খুদে রেল জানিয়ে দেয়‚ অত উঁচুতে সে আর উঠতেই পারবে না
দুই ফায়ারম্যান হাতে বালতি নিয়ে ছোটে ঝরনার দিকে বয়লারে জল দিয়ে শান্ত করে ইঞ্জিনকে তারপর ফার্নেসে কয়লা আর কাঠকুটো ঠুসে দিতেই গুম হয়ে দম নিতে থাকে খুদে রেলগাড়ি
দূরে উঁচুতে তিনধরিয়া স্টেশনের কাছে এক ন্যাড়া পাহাড়ের চুড়োয় একটেরে গাছটা হঠাৎ দমকা হাওয়ায় দুলে উঠে হাতছানি দেয় মুহূর্তে খুদে রেলগাড়িটা যাচ্ছি—’ বলে সিটি দিয়ে এক দমে সোজা পৌঁছে যায় আকাশের কাছে সেই তিনধরিয়া স্টেশনে
ক্রমে পার হয়ে যায় কার্শিয়াং সূ্র্যি নেমে আসে পাহাড় দেশের ছেলেরা রঙিন টুপি আর ডোরাকাটা জামা গায়ে দৌড়ের পাল্লা জমায় রেলগাড়ির সঙ্গে খুদে রেল ওদের সঙ্গে মজার খেলায় মেতে ওঠে কখনও এগিয়ে যায় কখনও দম ছেড়ে দিয়ে জিব বের করে আদ্যিকালের বুড়োর মতো ধুঁকতে থাকে পাহাড়ি ছেলের দল পিছন থেকে এসে ধরে ফেলে তাকে ঘন ঘন সিটি বাজিয়ে খুদে রেল ওদের তারিফ জানায়‚ হুত আচ্ছা
কাঠকুটোর মস্ত এক ঝুড়ি পিঠে নীচ থেকে উঠে এসেছিল একজন। ঘরে ফেরার তাড়া থাকলেও সামনে খুদে রেল দেখে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল: তুমি আগে চলো বন্ধু।
খেলতে খেলতেই সে পার হয়ে যায় অনেক পথ টুং স্টেশন পার হয়ে স্বপ্নের দেশ ঘুমএর বাতাসিয়া লুপে গোটা কয়েক চক্কর দিয়ে একসময় হুহু করে নামতে থাকে নীচে আলোর মালায় সেজে ওঠা দার্জিলিংয়ের দিকে রাত তখন বেড়ে উঠেছে আরও দুধারে ঘন অন্ধকার সারাদিনের ধকলের পরে চমৎকার ঠাণ্ডার আমেজে যাত্রীদের চোখ ঘুমে ঢুলঢুল 

খুদে রেলগাড়ি তারই মধ্যে একসময় পৌঁছে যায় দার্জিলিং স্টেশনে যাত্রীদের ভিড়‚ কুলিদের হইচইয়ের মাঝে ক্লান্ত রেলগাড়িটা দাঁড়িয়ে এই শীতের রাতেও হাঁসফাঁস করে হাঁপায় গায়ে গরম জামা চাপিয়ে তখন যাত্রীরা ছুটেছে হোটেলের দিকে সারাদিনের ক্লান্ত সঙ্গীটির কথা তখন আর মনেই নেই কারো


3 comments:

  1. অসাধারন। এই গরমে এক টুকরো হাওয়াবদল।

    ReplyDelete
  2. অসাধারন। এই গরমে এক টুকরো হাওয়াবদল।

    ReplyDelete