শিশির বিশ্বাস
অমাবস্যার রাতের ভরা জোয়ারে সুন্দরবনে নদীর জল যখন
ফুলে–ফেঁপে ওঠে‚ হুহু করে জল ঢুকে পড়ে বনের অসংখ্য শিস-খালের ভিতর। বাদার
মানুষ তখন জাল নিয়ে এই খালে মাছ ধরতে আসে।
বাদায় শিস-খাল হল সরু বা মজা খাল। বড় নদী থেকে বের
হয়ে বনের ভিতর খানিক দূরে শেষ হয়েছে। ভাঁটায় বিশেষ জল থাকে। শুধু
থকথকে কাদা।
সামশেরখালি গ্রাম আবাদ হলেও বাদা–জঙ্গলের লাগোয়া।
একদিকে রায়মঙ্গল নদী। অন্যদিকে সরু এক খাল। পার হলেই বাদার জঙ্গল। কেওড়া‚ গরান‚
বাইন‚ হেঁতাল
আর গোলপাতার অরণ্য। সেই জঙ্গলে হরিণ‚ দাঁতাল
বরার সঙ্গে ওত পেতে থাকে কেঁদো বাঘ। তাদের দু’একটা কখনও খাল পার হয়ে গ্রামে এসেও হানা দেয়। গাঁয়ের মানুষ
অবশ্য তাতে খুব একটা ঘাবড়ায় না। বনে যাদের নিত্য যাওয়া–আসা‚
তাদের কী আর এসবে ভয় পেলে চলে?
বনের কাঠ‚ গোলপাতা‚
মাছ আর মধু ভেঙেই তো দিন চলে ওদের।
খেতে চাষ–আবাদ‚
সে তো সারা বছরে একবার। তার উপর যদি
কখনও বর্ষায় বাধ ভেঙে নোনা জল ঢুকে পড়ে তো পরের দু’বছর মাটির লবণ না মরা পর্যন্ত তাও বন্ধ। অগত্যা বেঁচে
থাকতে হলে ওই বাঘের জঙ্গলই ভরসা!
সেদিন পৌষ মাসের এমনই এক নিশুতি অমাবস্যার রাত। খালের
জল ভরা জোয়ারের টানে থই–থই করছে। রাত একটু বাড়তে গাঁয়ের পরাণ সর্দার জালগাছা নিয়ে
নিজের ছোট নৌকোয় বেরিয়ে পড়ল জঙ্গলের দিকে। এমন রাতে বাদায় মাছ ধরতে বের হলে
সাধারণত দু’একজন
সঙ্গী নেয় সকলে। কিন্তু পরাণ পরোয়া করে না। ইদানীং একাই বের হয়। লম্বা
চওড়া মোষের মতো শরীর। ভয়ডর কম। তবে সেটাই একমাত্র কারণ নয়। সামান্য জমিজমা থাকলেও
তাতে চলে না। জন খেটেও কিছু উপায় হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য‚ গত বছর বাঁধ ভেঙে নোনাজল ঢোকায় চাষবাস বন্ধ। দিন চলাই
মুস্কিল। সঙ্গী নিলে তাকেও মাছের ভাগ দিতে হয়। একা
বেরোলে সেই দায় থাকে না।
গ্রামের অদূরে সরু এক শিস-খাল। সাধারণ জোয়ারে জল তেমন
না ঢুকলেও অমাবস্যার এই ভরা কটালে অন্য রূপ। জোরে দাঁড় টেনে একটু পরেই যথাস্থানে
পৌঁছে গেল ও। সরু শিস–খাল হলেও জলে থই–থই করছে। ভয়ানক জলের টান। জল যত বাড়ছে হুহু করে স্রোত
ছুটেছে শিস–খালের ভিতর। তবে একটু পরে ভাটার টান শুরু হলেই থম মেরে যাবে জলের
স্রোত। তবে তা অল্প সময়ের জন্য। তারই মধ্যে জলে নেমে লগি পুঁতে খালের মুখ জাল দিয়ে
আটকে দিতে হবে। একেবারেই দেরি করা চলবে না। কারণ একটু পরেই শুরু হয়ে যাবে ভাটার
টান। তখন উলটো দিকে জোরাল স্রোত শুরু হবে। হুহু করে জল শিস-খাল থেকে
বেরোতে শুরু করবে। তখন সেই স্রোত সামলে একা হাতে জাল টানায় অনেক সমস্যা।
খালের মুখে নৌকো বেঁধে অপেক্ষা করছিল পরাণ। একটু পরে
ভাটা শুরু হবার মুখে স্রোতের টান কমে আসতেই জলে নেমে দ্রুত জাল পেতে ফেলল। তারপর
শেষবারের মতো সব দেখে নিয়ে উঠে পড়ল নৌকোয়। পৌষ মাসের হিমেল রাত। ভয়ানক ঠাণ্ডাই
শুধু নয়। টপটপ করে হিম পড়ছে। পরনের ভিজে গামছা ছেড়ে আর দেরি করল না পরাণ। আধছেঁড়া
চাদরটা কোনওমতে গায়ে জড়িয়ে নৌকো ভাসাল বাড়ির দিকে।
অমাবস্যার ভরা জোয়ারের জল শিস–খাল থেকে নামতে ঘণ্টা
কয়েক সময় লাগে। তখন আটকে থাকা মাছ খালের অল্প জল–কাদায় লাফালাফি করে বেড়ায়। দ্রুত
ঝুড়িতে তুলে নিতে হয় তখন। মাঝের এই সময়টা কাছেই অপেক্ষা করার কথা। কিন্তু গায়ে
একমাত্র চাদরের যা অবস্থা‚
তাতে এই পৌষের শীত সামলানো মুস্কিল।
গত বছরই পালটানোর দরকার ছিল। হয়ে ওঠেনি। এবছরেও হবে কিনা সন্দেহ। পরাণ তাই আর
অপেক্ষা করে না। শিস–খালটাও বাড়ি থেকে খুব দূরে নয়। জাল পাতার কাজ শেষ করে ঘরে
ফিরে দিব্যি একটা ঘুম লাগিয়ে দেওয়া যায়। ফের বেরিয়ে পড়তে হয় শেষ রাতের দিকে।
ভাটার জল শিস-খাল থেকে সম্পূর্ণ নামার আগেই পৌঁছোতে
হয়। কাছেই গ্রাম। অনেকেই বদ মতলবে থাকে। দেরি হয়ে গেলে চুরি করে মাছ তুলে
নিয়ে যায়। গেল বছর ওপাড়ার গদাই মাছ চুরি করতে এসে হাতেনাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল। পরাণ
সেই থেকে খুব হুঁশিয়ার। তবু আজ একটু দেরিই হয়ে গেল।
বাড়ি ফিরে সেই যে লেপ মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল‚ যখন ভাঙল‚ বেশ দেরি হয়ে গেছে। নৌকো নিয়ে যখন যথাস্থানে পৌঁছোল‚ আলো ফুটতে দেরি নেই। খালের জল সম্পূর্ণ নেমে গেছে। ঘেরা
জালের ওধারে খালের মুখে শুধু থকথকে কাদা। কাছেই নৌকো বেঁধে পরাণ খালুই হাতে নেমে
পড়ল।
পৌষ মাসের শেষ রাত। কুয়াশাহীন পরিষ্কার আকাশ।
অমাবস্যার রাত হলেও চারপাশ বেশ দেখা যাচ্ছে। কেরোসিনের কথা ভেবে পরাণ তাই আর টেমি
জ্বালেনি। গেল সপ্তাহে সামান্য কেরোসিন কিনেছিল। প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। অযথা জ্বেলে
কী দরকার। আবছা অন্ধকারে দ্রুত জালের দিকে এগোতে গিয়ে হালকা খচমচ শব্দে কান
মুহূর্তে খাড়া হয়ে ওঠে। কী ব্যাপার! কাদার উপর অল্প জলে খেলে বেড়ানো মাছের মৃদু
খলবল শব্দ শোনা যাচ্ছে। সন্দেহ নেই‚ জালে
ভালই মাছ পড়েছে আজ। কিন্তু অন্য শব্দটা কিসের? তবে কি কেউ ফের মাছ চুরি করতে এসেছে?
খুব সন্তর্পণে পা টিপে টিপে প্রায়
নিঃশব্দে এগিয়ে গেল পরাণ।
যা ভেবেছে‚ ঠিক
তাই! আবছা অন্ধকারে বেশ দেখা যাচ্ছে‚ খালের
মাঝে থকথকে কাদায় মোটাসোটা ষণ্ডা চেহারার একটা মানুষ ওর দিকে পিছন ফিরে উবু হয়ে
কাদা থেকে মাছ তুলছে। ওই দেখে মুহূর্তে পরাণের মাথায় যেন খুন চড়ে গেল। এ গদাই না
হয়ে যায় না। পিছন থেকে চেহারাটা প্রায় সেই রকম। হতভাগার গত বছর ধরা পড়েও শিক্ষা
হয়নি! আবার কাণ্ড দেখ‚
চাদর মুড়ি দিয়ে আসা হয়েছে!
পা টিপে প্রায় নিঃশব্দে কাদার উপর দিয়ে এগিয়ে গেল
পরাণ।
‘হতভাগা‚ ফের
মাছ চুরি করতি এইছিস!’ বজ্র
হুঙ্কারের সঙ্গে মুহূর্তে পেল্লাই এক রাম রদ্দা পড়ল গদাইয়ের ঘাড়ে।
‘ঘ্যাঁত’ করে একটা হেঁচকি তুলে মুহূর্তে স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠল
গদাই। মুলোর মতো দু’সারি
ঝকঝকে দাঁত বিকশিত করে চারপায়ে এক তুড়ুক লাফে পরাণকে ঠেলে ফেলে সোজা খালের পাড়ে।
তারপর লম্বা লেজ তুলে বনবাদাড় ভেঙে ভোঁ দৌড়।
ওদিকে আবছা আলোয় আচমকা সেই দু’সারি দাঁত ঝকমকিয়ে উঠতেই পরাণের দাঁত কপাটি প্রায়
লেগে গিয়েছিল। তারপর সেই বিষম ধাক্কায় যখন কাটা কলাগাছের মতো খানিক দূরে কাদার উপর
চিতপাত হয়ে ছিটকে পড়ল‚ চিঁ–চিঁ করে গলা দিয়ে বা–বা–গো শব্দটুকু শুধু বের হয়েছিল।
তারপর আর কিচ্ছুটি মনে নেই।
গদাই নয়। বাদাবনের আস্ত এক কেঁদো বাঘ। স্বাভাবিক
খাদ্যে টান পড়লে সুন্দরবনের বাঘ মাছ কিংবা কাঁকড়াও খেয়ে থাকে। এক্ষেত্রেও হয়েছিল
তাই। শেষ রাতে শিকারের খোঁজে বেরিয়ে খালের কাদায় আটকে পড়া মাছ দেখে ভোজে বসে
গিয়েছিলেন। অন্ধকারে পরাণ পিছন থেকে তাকেই গদাই ভেবে এই বিপত্তি।
পরাণ বাদার মানুষ। যেমন তাগড়াই শরীর‚ সাহসও কম নয়। তবু আচমকা ওই ঘটনায় যে ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়েছিল‚ তা বলাই বাহুল্য। তার উপর বাঘটা লাফিয়ে উঠতে জোরাল ধাক্কায়
ছিটকে গিয়েছিল হাত কয়েক দূরে। তাই জ্ঞান যখন ফিরল‚ ভোর
হয়ে গেছে। ততক্ষণে শিস-খালে ফের জোয়ারের জল ঢুকতে শুরু করেছে। পৌষের ভোরে সেই
হিমশীতল জলের ঝাপটা গায়ে এসে লাগতে কেঁপে উঠে চোখ মেলতেই গোড়ায় মনে হয়েছিল‚ বুঝি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে। তারপরেই এক লহমায় মনে পড়ে গেল
সব। গা–ঝাড়া দিয়ে লাফিয়ে উঠল মুহূর্তে। চারপাশে কাদায় অজস্র বাঘের পায়ের দাগ। তবু
দিব্যি বেঁচেই আছে! শরীরে কুটোর আঁচড়টিও লাগেনি। ভাবতে গিয়ে বুকটা ফুলে উঠল পরাণের। শয়তানটার
বেজায় শিক্ষা হয়েছে আজ! চুপিসারে চিরকাল মানুষের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়া! এবার দ্যাখ‚ উল্টো রকম হলে কেমন লাগে! সামসেরখালির পরাণ সর্দারের মার!
এক রদ্দায় সেই যে লেজ তুলে পালিয়েছে‚ আর
এমুখো হয়নি। জ্ঞান ফিরতে আর অল্প দেরি হলে বরং অন্য এক বিপদ হয়ে যেত! যেভাবে
জোয়ারের জল বাড়তে শুরু করেছে‚
বেঘোরেই ডুবে মরতে হত।
জল বেড়ে উঠতে আটকে পড়া মাছ ইতিমধ্যে ফের জলে তলিয়ে
গেছে। কুড়িয়ে নেবার উপায় নেই। দেরি না করে এবার জাল গুটিয়ে নেওয়া দরকার। মনস্থির
করে পরাণ জালের দিকে এগোতে যাবে‚
নজর পড়ল পাশেই কাদায় পড়ে রয়েছে কেজি
দশেক ওজনের বিরাট এক আধখাওয়া ভেটকিমাছ। বাঘের দাঁত আর নখের আঘাতে প্রায় লণ্ডভণ্ড
হয়ে গেছে। ভনভন করছে মাছি। পরাণ বাদার মানুষ। ধরা তো দূরের কথা‚ কালীতলা বাজারে মহাজনের ঠেকেও এমন ঢাউস ভেটকি কোনও দিন
দেখেছে কিনা‚
মনে করতে পারল না। হায়–হায়‚ এই মাছটাই তাহলে রাতে জালে আটকেছিল! আর খোঁজ পেয়ে শয়তানটা
এসে হামলে পড়েছে! কী সর্বনাশ!
ক্ষোভে–দুঃখে পরানের তখন মাথার চুল ছিঁড়তে বাকি। এত
বড় মাছ! কালীতলায় মহাজনের ঠেকে নিয়ে ফেলতে পারলে আর দেখতে হত না। হপ্তার খোরাকি
মিটিয়ে একটা চাদর কেনাই যেত এবার। এই শীতে নৌকোয় বেরোতে কী যে কষ্ট!
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
Darun laglo etao.....
ReplyDeleteAccha akta proshno chili.. kedo bagh ta ki dhoroner baagh??
কেঁদো শব্দের অর্থ প্রকাণ্ড বা মোটা। ডোরাকাটা বড় বাঘকে তাই কেঁদোবাঘও বলে। ধন্যবাদ।
Deleteohh achha....bujhechi
DeleteKhub valo laglo
ReplyDeleteভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা
ReplyDelete