খাওয়াদাওয়ার প্রতি বটকেষ্ট বটব্যাল ওরফে বটুবাবুর দুর্বলতা
অনেক দিনের। সম্ভবত সেই কারণেই
দাঁতের পরিচর্যার জন্য অনেকটা সময় ব্যয় করেন। অন্যথা হয়নি সেদিনও। ভোর সকালে ঘুম থেকে উঠেই ব্রাশে বেশ অনেকটা পেস্ট লাগিয়ে
সবে জুত করে ধরেছেন, হঠাৎ যেন
বিষম খেলেন। মুখটা বেঁকে কতকটা
বাংলা পাঁচের মতো হয়ে গেল। আঁতকে
উঠে অস্ফুট স্বরে শুধু বললেন, ‘অ্যাঁ! আমার দাঁত?’
ব্রাশ-ট্রাশ ফেলে তাড়াতাড়ি আয়নার সামনে এলেন তিনি। মস্ত হাঁ করলেন। নাহ, পরিষ্কার মুখের ভিতর এক জোড়া মাড়ি শুধু তকতক করছে। দু’পাটি দাঁতের চিহ্নমাত্র নেই। অথচ গত রাত্তিরে দাঁত দু’পাটি মুখেই ছিল। হায় হায়! আজ যে আবার পরিতোষের বউভাত! স্পেশাল পোলাও পাঁঠার ব্যবস্থা
হয়েছে সেখানে। আর
এদিকে তাঁর সাধের দাঁত দু’পাটিই গায়েব
হয়ে গেল! তাও কিনা খোদ মুখের ভিতর থেকে! ডাক ছেড়ে হাউমাউ করে কাঁদতে ইচ্ছে হল বটুবাবুর। আর সেই সময়ে দরজার সামনে দিব্যি দু’পাটি দন্ত বিকশিত করে হাজির হলেন সহকর্মী পাশের
বাড়ির দিনু দত্ত।
‘হেঁ হেঁ, কী খবর বটু?’
যেন তাকে দেখাবার জন্যই দাঁত দু’পাটি আরও বেশি
করে বিকশিত করলেন দিনু দত্ত।
বটুবাবু এবার সত্যিই ভিরমি যাবেন। এই গতকালও যে লোকটার মুখের ভিতর তকতকে এক জোড়া মাড়ি
ছাড়া কিছু ছিল না, সেখানে রাতারাতি
দিব্যি দু’পাটি দাঁত আসে কোত্থেকে? কই,
গতকাল সারাদিন দিনুর সঙ্গে যে এতবার দেখা হল, দাঁতের
ব্যাপারে কিছুই তো বললে না কখনও! বটুবাবু হঠাৎ অনুভব করলেন,
তাঁকে ঘিরে এক গভীর ষড়যন্ত্র চলছে। নইলে তিন তিনবার তাঁর দাঁত চুরি যায়!
দাঁত চুরি! কেউ শুনেছ এমন কথা? মানুষের সোনাদানা চুরি যায়। টাকাপয়সা চুরি যায়। ছিঁচকে চোরের খপ্পরে পড়লে চুরি যায় থালা-বাসন, কাপড়চোপড়। কিন্তু দাঁত চুরির কথা কে কবে শুনেছে?
তবে এই যে তিনি সাত সকালে ঘুম থেকে উঠে, দাঁত চুরি গেছে বলে চ্যাঁচামেচি জুড়লেন,
তা কী এমনি? বটুবাবু তো আর পাগল নন। নিপাট ভালমানুষ। পাশের বাড়ির বন্ধু দিনুর সঙ্গে নিয়মিত চৌরঙ্গীতে অফিস
করেন। কে কবে তাঁকে পাগল
বলেছে? দোষের মধ্যে কেবল যা একটু
খাই-খাই বাতিক। ছোটখাটো পাতলা প্যাঁকাটির মতো চেহারা। কিন্তু খেতে বসলে মিনিট পাঁচেকের ভিতর কেজি পাঁচেক মাংস
হাড়গোড় সুষ্ঠু ভ্যানিস করে ফেলতে পারেন। সাথে পোলাও, কালিয়া আর শেষে কেজি কয়েক দই, রসগোল্লা তো ফাউ। আর এই খাই-খাই করেই না সেবার তাঁর অমন লোহার মতো দু’পাটি বাঘা দাঁত
দিন-দুপুরে ডাকাতি হয়ে গেল!
গোড়া থেকেই বলি তাহলে। বটুবাবু কাজ করেন এক মার্চেন্ট অফিসে। বেশ বড়সড় সাহেবি কোম্পানি। কাজের মানুষ বলে উপর মহলে যেমন সুনাম, তেমন নাম কিনেছিলেন ডাকসাইটে খাইয়ে বলেও। আর তাই কাল হয়ে দাঁড়াল শেষ পর্যন্ত।
সেবার বড়দিন উপলক্ষে অফিসের বড়সাহেব বাড়িতে জবরদস্ত
পার্টি দিয়েছিলেন। ঢালাও আয়োজনে বটুবাবু
ছিলেন চিফ গেস্ট। স্রেফ তাঁর খাওয়া
দেখার জন্য বড়সাহেব নাকি নেমতন্ন করেছিলেন উপর মহলের অনেককে। শুনে মানুষটি তো আহ্লাদে আটখানা। দিন কয়েক নেচে-কুঁদে বেড়ালেন সারা অফিস জুড়ে।
কথা দিয়েছিলেন, পরের দিন সবিস্তারে গল্প শোনাবেন সবাইকে। কিন্তু সেদিন অফিসে তাঁর টিকির দেখাও পাওয়া গেল না। আসল খবরটা পরে জানা গেল দিনু দত্তর কাছে। বড়সাহেবের বাড়ির খাওয়ার টেবিলে থরে–থরে সাজানো খাবার দেখে আর মাথা ঠিক রাখতে পারেননি
তিনি। কাঁটাচামচ হাতে
নিমেষে হামলে পড়েছিলেন সামনের মাংসের ডিশের উপর। আর তারপরেই অঘটন। গোটা কয়েক টুকরো কাঁটাচামচে গেঁথে সবে মুখে পুরেছিলেন, তারপরেই দু’বার মাত্র
‘আঁউ-আঁউ’ শব্দে জ্ঞান হারিয়ে
একেবারে হুমড়ি খেয়ে টেবিলের উপর।
সে এক ভয়ানক ব্যাপার! বড়সাহেব অবশ্য দেরি করেননি। ধরাধরি করে তৎক্ষণাৎ নিয়ে গিয়েছিলেন হাসপাতালে। তারপর জ্ঞান-ট্যান ফিরলে পৌঁছে দিয়ে গেছেন বাড়িতে।
ব্যাপার আর কিছু নয়। আসলে ভালমন্দ কিছু খেতে বসলে কখনই বাহ্যজ্ঞান থাকে না
বটুবাবুর। সেদিন তো আরও ছিল
না। ঝোঁকের মাথায় কাঁটাচামচ
সুদ্ধই কামড় বসিয়ে দিয়েছিলেন মাংসে। আর
বটুবাবুর সেই কামড় মানে একেবারে বাঘা কামড়। বেকায়দায় পড়তেই দু’পাটি মাড়ি প্রায় সাফ। পাঁচ জোড়া দাঁত তো হুড়মুড় করে ছিটকে বেরিয়ে এসেছে
তৎক্ষণাৎ। আরও পাঁচ জোড়া
গেছে নড়ে। কোথায় বড়সাহেবের
বাড়ি নেমতন্ন! দিন সাতেক
স্রেফ দুধ-বার্লি খেয়ে বিছানায় পড়ে রইলেন।
এরপর মাসখানেক তাঁর সত্যিই দুঃসময়। বিয়ে আর বউভাতের মরসুম। খোদ অফিসেই গোটা চারেক ছোকরার বিয়ে হয়ে গেল। বটুবাবু ফ্যাল ফ্যাল করে দেখলেন শুধু। একটু দই–মিষ্টি ছাড়া মুখে আর কিছু ছোঁয়াতে পারলেন না। একে তো পাঁচ-পাঁচ জোড়া দাঁত লোপাট। তাঁর
উপর পাঁচ জোড়া সমানে হড়বড় করে নড়ছে। পাঁঠার মাংস দূরস্থ, মেটলিটুকু দাঁতে কাটে সাধ্য কী!
শেষটা সেই অমানুষিক দুরবস্থা থেকে তাঁকে উদ্ধার করলেন
অফিসের বড়সাহেব নিজেই। একদিন
চেম্বারে ডাকিয়ে একটা ঠিকানা দিয়ে বললেন,
‘মিঃ বটব্যাল, তুমি আজই এখানে চলে যাও। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে এবার। চিন্তা নেই।’
ঠিকানাটা চিনে বাজারের এক ডেনটিস্টের। বটুবাবু সেই দিনই ছুটলেন সেখানে। ডাক্তার খানিক দেখে-টেখে পেল্লায় এক সাঁড়াশি বাগিয়ে প্রায় ঝড়ের বেগে তাঁর মাড়ি
দুটোকে বিলকুল সাফ করে ফেললেন। সাহেবের
কথায় বড় আশা করেই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিলেন তিনি। ফিরে এলেন একরাশ নিরাশা নিয়ে। ভেবেছিলেন, খোদ বড় সাহেব যখন পাঠিয়েছেন, নিশ্চয় নামি ডাক্তার। নড়ে যাওয়া দাঁতগুলো ফের শক্ত করে দেবেন। তাঁর বদলে এ কী কাণ্ড! দু’চারটে ভাল দাঁত যাও বা ছিল, এ যে সেগুলোও ফিনিস করে দিলে! দুঃখে মাথার চুল ছিঁড়তে
ইচ্ছে হল বটুবাবুর। সাহেব
ফের এ কী সর্বনাশ করলেন তাঁর!
যাই হোক, ফোকলা মুখ নিয়ে এরপর দিন কয়েক আর বাড়ির বাইরেই বেরলেন না। কিন্তু সে আর কদিন? এর মধ্যেই অফিস থেকে একদিন জরুরি তলব এসে হাজির। অগত্যা চাকরি রাখার তাগিদে যেতেই হল। কী কাণ্ড! অফিসে এসেই শোনেন, বড় সাহেব আজ মস্ত এক পার্টির আয়োজন
করেছেন। তিনি ফের চিফ গেস্ট। বড়-বড় হাণ্ডা ভরতি স্পেশাল বিরিয়ানি আর মাংস আসছে সিরাজ থেকে। সারা অফিস জুড়ে উৎসবের মেজাজ। শুনে তো আরও মুষড়ে পড়লেন তিনি।
তারপর যথাসময়ে ঘর-ভরতি মানুষের সামনে সাহেব যখন বললেন, ‘হ্যাল্লো
মিঃ বটব্যাল, একটু হাঁ করো দেখি।’
সাহেবের কথা অমান্য করার উপায় নেই। বটুবাবু তো তক্ষুনি চোখ-টোখ বুঁজে মস্ত হাঁ করেছেন। আর সাহেব তৎক্ষণাৎ পকেট থেকে দু’পাটি বাঁধানো দাঁত বের করে পরিয়ে দিলেন তাঁর
ফোকলা দুই মাড়িতে। দেখে
হাততালি দিয়ে উঠল সবাই। আর
আনন্দে বটুবাবুর তো চোখে জল আসার জোগাড়। খাওয়ার টেবিলে প্লেট বিশেক মাংস হাড়গোড় সুধু উড়িয়ে দিলেন
তখনই। পরে জানা গেল, হংকং-এর কোন এক ডাকসাইটে
ডেনটিস্টকে দিয়ে দাঁত দু’পাটি করিয়ে এনেছেন তিনি।
এরপর বটুবাবুকে আর পায় কে। সেই দাঁত দু’পাটির গুনে ঝিমিয়ে-পড়া মানুষটি ফের চাঙ্গা হয়ে উঠলেন‚ এবং যথারীতি নেমতন্ন-বাড়িতে
পাঁঠা, মুরগির মুণ্ডুপাত করে চললেন। কিন্তু এই অপার সুখ সইল না বেশিদিন। বছর ঘোরার আগেই চুরি গেল সেই দাঁত। রাত্তিরে শোয়ার আগে, দাঁত দু’পাটি খুলে বেশ করে ধুয়ে-টুয়ে খালি একটা গয়নার বাক্সে ভরে যত্ন করে দেরাজে তুলে রাখতেন। সেদিন রাতে, জানলার শিক বাঁকিয়ে ঘরে ঢুকল সিঁধেল চোর। তারপর দেরাজ খুলে টাকাপয়সার সাথে সেই সাধের দাঁত-সমেত বাক্সটাও নিয়ে গেল।
টাকাপয়সার জন্য নয়। দাঁতের শোকেই বেজায় কাবু হয়ে পড়লেন বটুবাবু। বড় সাহেব ততদিনে সিঙ্গাপুরে বদলি হয়ে গেছেন। কিন্তু এ-যাত্রায় তাঁকে বাঁচিয়ে দিলেন অফিসের নতুন সাহেব। ততদিনে বটুবাবুকে বিলক্ষণ চিনে ফেলেছেন তিনি। মানুষটির দুরবস্থা দেখে সিঙ্গাপুরে পুরনো সাহেবের সঙ্গে
যোগাযোগ করলেন নিজেই। তাঁর
কিছুদিন পরে অফিসের ঠিকানায় এক পার্সেল এসে হাজির। হংকং-এর সেই পুরনো ডেনটিস্টকে দিয়ে নতুন দু’পাটি বাঁধানো
দাঁত পাঠিয়ে দিয়েছেন পুরনো সাহেব। সেই উপলক্ষে নতুন সাহেব অফিসে বটুবাবুর অনারে চটজলদি একটা ভোজের
আয়োজনও করে ফেললেন।
বলা বাহুল্য, মুষড়ে-পড়া মানুষটির এরপর চাঙ্গা হয়ে উঠতে দেরি হয়নি। নতুন দাঁত দু’পাটি কপালে ঠেকিয়ে ‘জয় বাবা বড় সাহেব’ বলে সেই যে মুখে পুরেছিলেন, ফের চুরি যায় এই ভয়ে আর
মুখ থেকে বের করেননি। এমন
কী ঘুমোতে যাবার সময়েও মুখের ভিতর। সৃষ্টিছাড়া
এই কাণ্ড দেখে কেউ কিছু বললে অবশ্য বিশদে ভাঙেন না কিছু। একটু মুচকি হেসে শুধু বলেন, ‘মুখের জিনিস তো। ওটা মুখে থাকাই ভাল। ঢের শিক্ষা হয়েছে সেবার।’
তা কাণ্ড দ্যাখো, এবার সেই মুখের ভিতর থেকেই চুরি গেল বটুবাবুর দাঁত। আর তাও কিনা ভাগনে পরিতোষের বউভাতের দিন! গতকাল নিজে দাঁড়িয়ে বেছে-বেছে বাজার থেকে দশ-দশটা পুরুষ্টু পাঁঠা আনিয়েছেন। পরিতোষের বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছিলেন। কেজি পাঁচেক পাঁঠার মাংস দিয়ে জলযোগটা সেরে এসেছেন মাত্র। আজ বউভাতে পুরো খাওয়াটা সারবেন, সেই মতলব। তাই গত সন্ধেয় পাঁঠাগুলো পরিতোষের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে
রাতে আর বিশেষ কিছু খাননি। খিদেটা
একটু জমিয়ে নেওয়া দরকার। সেই
কারণে স্রেফ এক গ্লাস লেবুর জল খেয়ে শুয়ে পড়েছিলেন।
রাত্তিরে ঘুমটাও হয়েছিল বেশ জমাট। প্রথম রাতে সেই যে স্বপ্নটা দেখেছিলেন, পরিতোষের বাড়িতে বাঁধা দশ-দশটা পাঁঠার মুড়ো তিনি যেন খাওয়ার পাতে হাড়গোড় সুষ্ঠু কড়মড় করে চিবিয়ে
খাচ্ছেন, তারপর এমন দারুণ ঘুম হয়েছে যে, সারা রাত্তিরে চোখের পাতা মেলতে হয়নি।
সকালে উঠে কোথায় পরিতোষের বাড়ি পাঁঠার ব্যবস্থা করতে
ছুটবেন। আর এদিকে কিনা রাতারাতি
তাঁর সাধের দাঁত দু’পাটি খোদ মুখের
ভিতর থেকে লোপাট হয়ে গেল! হায় হায়! অমন
পয়মন্ত দাঁত, দ্বিতীয়টি তিনি আর কোথায় পাবেন? বটুবাবুর চোখের সামনে পরিতোষের বাড়িতে বেঁধে রাখা দশ-দশটা পাঁঠা যেন একে-একে ভেংচি কেটে চলে যেতে লাগল। ডাক ছেড়ে নেচে-নেচে কাঁদতে ইচ্ছে হল তাঁর।
কিন্তু তখন কাঁদবার সময় কোথায়? গোড়ায় অতশত বোঝেননি। কিন্তু দিনু দত্তর মুখে হঠাৎ দু’পাটি দাঁত দেখে গভীর ষড়যন্ত্রের আভাষ পেলেন
যেন। কদিন ধরেই দিনুটা
ফোকলা মুখ নিয়ে আশপাশে ঘুরঘুর করছিল। জ্বলে
যাচ্ছিল হিংসেয়। কথায়-কথায় প্রায়ই বলত, ‘তুমি
তো ভাই সাহেবদের ধরে তরে গেলে। আমি
যে কাকে ধরে কী করাই? কলকাতায়
তেমন ডেনটিস্ট কি আর আছে?’
এদিকে বটুবাবুর মুখে বাক্য নেই দেখে দিনু দত্ত ফের তাঁর
দন্তপাটি বিকশিত করে বললেন, ‘হেঁ হেঁ,
কথা কইছ না কেন বটু? পরিতোষ ভায়ার বাড়ি যাচ্ছ
তো আজ? তা ব্যবস্থাপত্র কী হচ্ছে তাই জানতে এলুম। আমিও যাচ্ছি কিনা।’
মনে-মনে দিনু দত্তর মুণ্ডপাত করলেন তিনি। দাঁড়াও দিনু, পরিতোষের বাড়ি তোমার নেমতন্ন খাওয়া বের করছি আমি। সন্ধের আগে তোমার ওই দু’পাটি দাঁত সুষ্ঠু থোঁতা মুখ যদি ভোঁতা না করেছি
তো আমার নাম বটকেষ্ট বটব্যালই নয়।
অবশ্য মুখে ভাঙলেন না কিছু। এখনই দিনুকে ঘাঁটিয়ে দরকার নেই। কোনও মতে সামলে নিয়ে, মুখে অমায়িক হাসি টেনে শুধু বললেন, ‘খুব
ভাল, সে তো খুব ভাল কথা দিনু। সন্ধেয় তাহলে এস ওখানে। দেখা হবে।’
শুনে দিনু দত্ত হেঁ হেঁ করে খানিক এগিয়ে এলেন আরও। এদিকে বটুবাবুর হাতে তখন সময় নেই। মেলা কাজ এখন তাঁর। কী করে দিনুটাকে ভাগানো যায় ভাবছেন। রক্ষা পেয়ে গেলেন পেটে আচমকা কামড় দিয়ে উঠতে। সকালের প্রাকৃতিক তাড়না চাগাড় দিয়েছে হঠাৎ। অগত্যা দিনু দত্তকে তাড়াতে বেশি বেগ পেতে হল না। প্রাতঃকৃত্য প্রভৃতি সেরে বটুবাবু দেরি করলেন না আর। দিনু আবার কখন এসে ঝামেলা করে সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি পোশাক
পালটে বের হয়ে পড়লেন বাড়ি থেকে।
ক্যামাক স্ট্রিটে অফিসবাড়ি ছাড়িয়ে একটা সরুমতো গলি। তাঁরই গায়ে এক ছোট্ট অফিস ঘর। দরজার পাশে নেম প্লেটে লেখা, মিঃ রণেন রায়। ইউনিভার্সাল ডিটেকটিভ। বটুবাবু বাড়ি থেকে বের হয়ে ট্যাক্সি ধরে সোজা সেই অফিসের
দরজায় এসে নক করলেন।
বেশ সাজানো-গোছানো ঘর। মস্ত
টেবিলে গোটা কয়েক টেলিফোন। একজন
রোগা টিংটিঙে ছোকরা টাই-ফাই বেঁধে
বসে আছে। ইউনিভার্সাল ডিটেকটিভের
চেহারা দেখে গোড়ায় বেশ ঘাবড়েই গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ছোকরাটি রীতিমতো গুরুগম্ভীর গলায় যখন তাঁকে বসতে
বললেন, তখন ধপ করে বসেই পড়লেন।
‘বুঝলেন সার, গত রত্তিরে
আমার দু’পাটি দাঁত চুরি হয়ে গেছে।’ কাঁদো-কাঁদো গলায় বটুবাবু বললেন। শুনে ডিটেকটিভ ছোকরা তো ফিক করে হেসেই ফেললেন একটু। এমন সমস্যা নিয়ে কেউ কখনও আসেনি তাঁর কাছে। তাও এই সাতসকালে! এদিকে তাকে ওইভাবে হেসে ফেলতে দেখে ফের হাউমাউ করে উঠলেন বটুবাবু,
‘হাসির কথা নয় সার! জীবন-মরণ সমস্যা আমার।’
ততক্ষণে ডিটেকটিভ ছোকরা সামলে নিয়েছেন। গম্ভীর গলায় বললেন, ‘তাই নাকি?’
‘ঠিক তাই সার। হংকং থেকে বড় সাহেবের পাঠানো অমন দারুণ দাঁত আর একটা
পাই কোথায় এখন?’
পরিস্থিতি এতক্ষণে কিছুটা যেন হৃদয়ংগম করলেন ভদ্রলোক। বললেন,
‘তা দাঁত জোড়া রেখেছিলেন কোথায়?’
‘মুখের মধ্যে সার। রাতারাতি দাঁত দু’পাটি এই মুখের ভিতর থেকে গায়েব!’ ফোকলা মুখে মস্ত একটা
হাঁ করলেন বটুবাবু। ‘আমার আবার একটু হাঁ করে ঘুমনো অভ্যাস কিনা সার। আর সেটাই কাল হয়ে গেছে!’
‘বলেন কী! খোদ মুখের ভিতর
থেকে চোর দাঁত খুলে নিয়ে গেল?’
‘আজ্ঞে হ্যাঁ সার। আর সে দাঁত চুরি করেছে আমার কলিগ, আমার প্রতিবেশী বন্ধু ওই দিনু, মানে দিনু দত্ত।’ দারুণ উত্তেজনায় প্রায় ঝড়ের গতিতে বলে গেলেন
বটুবাবু।
‘বলেন কী! বন্ধু দিনুবাবু
চুরি করেছেন আপনার দাঁত?
‘তবে আর বলছি কী সার।’ মুখ কাঁচুমাচু করে হাত কচলাতে লাগলেন বটুবাবু। ‘আপনি আজ সন্ধ্যেয়
পরিতোষের বউভাতের আসরে, সর্বসমক্ষে দিনুর কীর্তি ফাঁস করে আমার
দাঁত দু’পাটি উদ্ধার করে দিন। ওই দাঁত না পেলে আজ নেমতন্নটাই মাঠে মারা যাবে। দশ-দশটা পাঁঠা সার! নিজে…’
বলতে-বলতে তড়াক করে চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠলেন বটুবাবু। বাপরে! ফের কামড় দিয়েছে পেটে। মরণ কামড়। চোখমুখ
কুঁচকে প্রায় ডিম ভাজার মতো হয়ে গেলেন। উপায় নেই। তাড়াতাড়ি
পকেট থেকে গোটাকয়েক নোট বের করলেন তিনি। ‘এই নিন সার আপনার অ্যাডভান্স,
আর ঠিকানাটা। বিকেলে
যথা সময়ে পরিতোষের বউভাতের আসরে দিনুর কীর্তি ফাঁস করে, আমার দাঁত দু’পাটি উদ্ধার
করে দিতেই হবে। এদিকে
আমার একটু ইয়ে…।’ বলেই কোনও
মতে সব টেবিলে রেখেই এক লাফে দরজার বাইরে।
পেট চেপে তাড়াতাড়ি পথে নেমেই ট্যাক্সি ধরলেন বটুবাবু। গত রাত্তিরে পেটে কিছু পড়েনি। হতচ্ছাড়া পুরনো অম্বলটা চাগাড় দেওয়ার আর সময় পেলে
না! সময় বুঝে বেইমানি করলে
এমন! ডিটেকটিভবাবুকে সব কথা ভাল করে বলাই হল না। তারই ভিতর সান্ত্বনা যে, সন্ধের আগে পেটটা বেশ সাফ হয়ে যাচ্ছে। মন্দের ভাল। কিন্তু ঘটে গেল অন্য ব্যাপার। ট্যাক্সি তখন সবে এলগিনের মোড়ে। হঠাৎ গেলুম-গেলুম বলে দুবার ডাক ছেড়ে, গোঁ-গোঁ করে চোখ উলটে সিটের উপর এলিয়ে পড়লেন তিনি।
দেখে
ড্রাইভার তো হতভম্ব। গাড়ি
থামিয়ে, বার কয়েক ডাকলেন বটুবাবুকে। কিন্তু জবাব দেবে কে? তাঁর তখন শিবনেত্র অবস্থা। গতিক সুবিধের নয় বুঝে তিনি এবার সোজা গাড়ি ঘোরালেন সেই
ইউনিভার্সাল ডিটেকটিভসের অফিসে।
ইউনিভার্সাল ডিটেকটিভসের ছোকরা রণেন রায় সত্যিই তাঁর
খেল দেখালেন এবার। বলতে গেলে তাঁরই
ব্যবস্থায় সন্ধের আগেই দাঁত দু’পাটি ফিরে পেলেন বটুবাবু। সেই সাথে এযাত্রার মতো প্রাণটাও। বটুবাবুকে ট্যাক্সি ড্রাইভার ওই অবস্থায় এনে হাজির করার
পর ব্যাপারটা বুঝতে বিলম্ব হয়নি তাঁর। তৎক্ষণাৎ
তাঁকে নিয়ে ছুটেছিলেন হাসপাতালের দিকে।
তারপর আর কী? ইউনিভার্সাল ডিটেকটিভসের রণেন রায়ের তৎপরতায় এরপর ডাক্তার, আত্মীয়স্বজন আর বন্ধুবান্ধবের ছুটোছুটি।
কী, এবার বুঝতে পারছ তো ব্যাপারটা? আসলে হয়েছিল কী,
সেই যে রাত্তিরে ঘুমের ঘোরে দশটা পাঁঠার মুড়ো চিবিয়ে খাওয়ার স্বপ্ন
দেখেছিলেন বটুবাবু, সেই সময় ঝোঁকের মধ্যে পাঁঠার মুড়ো নয়,
খোদ দাঁত দু’পাটিই কোঁত করে গিলে ফেলেছিলেন। যাই হোক, সন্ধের খানিক আগেই জ্ঞান ফিরে এল বটুবাবুর। তারপর প্রথমেই তাঁর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আমার দাঁত?’
রণেন রায় প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তাড়াতাড়ি গ্লাসে ভেজানো দু’পাটি দাঁত তাঁর চোখের সামনে দু’বার নাচিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আপনার দাঁত উদ্ধার করা হয়েছে
সার। চিন্তা নেই।’
‘আর পরিতোষের বউভাত?
দু’পাটি দাঁত বের করে এবার দিনু দত্ত ঝুঁকে পড়লেন সামনে, ‘পরিতোষ ভায়ার বউভাত ছয় মাস পিছিয়ে গেছে বটু। খুব বেঁচে গেছ এযাত্রায়। পেটে দশ ইঞ্চি অপারেশন করে তোমার দাঁত উদ্ধার হয়েছে। এখন মাস তিনেক দুধ-বার্লি ছাড়া তোমার ডায়েটে আর কোনও আইটেমই নেই।’
ছবি: তুষারকান্তি চ্যাটার্জী (সৌজন্য: শুকতারা)
শুকতারা: অগ্রহায়ণ ১৩৮৬
byapok mojar... :) :D
ReplyDeleteDarun mojar.
ReplyDeleteSuktara te pore chilam. Etodin pore abar pore khub valo laglo.
ReplyDeleteভালো লাগল পরে
ReplyDeleteভালো লাগল পড়ে ।
ReplyDeleteভারি সুন্দর গল্প। বহুদিন পরে এমন সুন্দর নির্মল আনন্দের গল্পটি পড়ে প্রাণ খুলে (থুড়ি দাঁত খুলে )হাসলুম।
ReplyDelete