হাসির গল্প (মোবাইল ভার্শন)
মাকুমামার ভালুক কাণ্ড
শিশির বিশ্বাস
গোড়াতেই বলে রাখি এটা কোনও ভালুক শিকারের গল্প নয়। বিশেষত মাকুমামার সেই নিদারুণ ব্যাঘ্ৰ কাণ্ডের পর তিনি
যে বন্দুক কাঁধে ফের শিকারে বের হবেন এমন ধারণা করাটাই অন্যায়। মাকুমামা তো আর পাগল নন। সেবার পালামৌ থেকে ফিরে সেই যে মুটে ডেকে তাঁর শিকারের
বইপত্তর, মায় সাধের নোট খাতা সের
দরে বিদেয় করেছিলেন, তারপর ওসব আর মুখেও আনেননি। এমনকী ছেড়ে দিয়েছেন আগের চাকরিও। ডালটনগঞ্জের সেই শিবশঙ্কর রায়ের সুপারিশে জয়েন করেছেন
নতুন এক অফিসে। তবু তাঁর ভালুক
কাণ্ডটিও হয়ে গেল। আর এবারেও সেই পালামৌ
জঙ্গল। তবে সেবার মামা
একাই ছিলেন মুখ্য চরিত্র। এবার
জুড়ে নিলেন আমাকেও।
সেদিন মাকুমামা এসেই বললেন, ‘চল রে ফুচে, একটা ট্যুর
মেরে আসি। দারুণ জায়গা। পরীক্ষার পরে আমার তখন অখণ্ড অবসর। লাফিয়ে উঠে বললাম, কোথায় মামা?’
একগাল হেসে মাকুমামা বললেন, ‘নেতারহাটের নাম শুনেছিস তো? সাহেবরা যার নাম দিয়ে গেছে কুইন অব ছোটনাগপুর। দারুণ একটা বাংলো ম্যানেজ করে ফেলেছি। সপ্তা দুই বেড়িয়ে আসতে পারলে শরীর ফিরে যাবে।’
সুতরাং দিন কয়েকের ভিতর জিনিসপত্তর গুছিয়ে আমরা একদিন
রাঁচি পৌঁছে নেতারহাটের বাসে চেপে বসলাম। পুরো ব্যাপারটা শোনা হল বাসে বসেই। মামার শরীরটা ইদানীং ভালো যাচ্ছিল না। ডাক্তার চেঞ্জে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু সস্তায় তেমন যায়গা কোথায়? শেষে খোঁজখবর নিয়ে শুনলেন, অফিসের বড় সাহেবেরই নাকি নেতারহাটে বাংলো রয়েছে। জায়গাটা চেঞ্জের পক্ষেও দারুণ। এরপর সাহেবকে ম্যানেজ করে ফেলতে বিশেষ দেরি হয়নি। তার উপর খবর পেয়েছি বাংলোর মালি ঝগড়ুর রান্নার হাতও দারুণ! মুরগিও সস্তা। সুতরাং দু’বেলা খাও আর ঘরে বসে সানরাইজ, সানসেট দেখো।
লোহারদাগা থেকেই শুরু হয়ে গেল ছোটনাগপুরের লাল মাটি আর
আদিবাসীদের গ্রাম। তারপর বাস এক সময়
নেতারহাটের পাহাড় বেয়ে উঠতে শুরু করল। পথের দুপাশে জঙ্গল ঘন হয়ে উঠল ক্রমশ। বাসে মাকুমামা এতক্ষণ দারুণ মেজাজে বোঝাচ্ছিলেন আমাকে। হঠাৎ বাইরে তাকিয়ে কেমন ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন। ঠোঁট ইঞ্চি দুয়েক ঝুলে পড়ল। ঘাড় ঘুরিয়ে বললেন, ‘এটা কী রকম ব্যাপার হল! এ যে পালামৌ জঙ্গল
রে ফুচে! সেই পাহাড়! বন জঙ্গল!’
আমি বললাম,
‘নেতারহাট তো পালামৌ জেলার মধ্যেই মামা।’
বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে মাকুমামা বললেন, ‘তবে যে সবাই বললে কুইন অব ছোটনাগপুর!
ফুচেরে, ভালোয়-ভালোয় এখুনি
ফিরে চল বাবা। এ বড়
ডেঞ্জারাস জায়গা।’ নিমেষে ‘রোখকে-রোখকে’ বলে চ্যাঁচাতে চ্যাঁচাতে মালপত্র টানাটানি শুরু
করে দিলেন তিনি।
চোখমুখ দেখে বুঝলাম ভীষণ নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ফিরে যাই বললেই তো হয় না। বললাম,
‘খেপেছ মামা! এই জঙ্গলের মধ্যে বাস থেকে নেমে যাবে
কোথায়?’
পরিস্থিতিটা এবার খানিকটা যেন বুঝলেন তিনি। মালপত্র টানাটানি থামিয়ে কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, ‘ফুচেরে,
তুই জানিসনে, এ কী ভয়ানক জায়গা। কী হবে এবার বল দেখি?’
‘এখন আর ভেবে লাভ নেই মামা। এ বাস রাঁচি ফিরবে আগামীকাল সকালে। সুতরাং আজ আমাদের সেই বাংলোয় থাকতেই হচ্ছে। কাল সকালের আগে আর ফেরবার উপায় নেই।’
যথাসময়ে নেতারহাট পৌঁছে গেলাম। মাকুমামা সত্যিই কাজের মানুষ। ব্যবস্থা করাই ছিল। বাংলোয় পৌঁছে দেখি সব একদম রেডি। সুতরাং মালপত্র নামিয়ে রেখেই ছুটলাম স্নানের ঘরের দিকে।
ঝগড়ু সিং-এর হাতের রান্নার সত্যিই জবাব নেই! লোকটা দেখতে অবশ্য
জুতের নয় তেমন। তাগড়াই
শরীর ভরতি কিম্ভুত বড়-বড় লোম। আর গায়ের রং? তিন পোঁচ আলকাতরা মাখালেও বুঝি অমন খোলতাই হয় না। নিশ্বাসের সময় ঘোঁত–ঘোঁত শব্দ হয় সমানে। দেখে গোড়ায় তো বেশ দমেই গিয়েছিলাম। যাই হোক, দেহাতি মুরগির ঠ্যাং দিয়ে প্লেট পাঁচেক করে ভাত মেরে বিকেলে বাংলোর হাতায়
চেয়ার টেনে বসলাম। জুড়িয়ে
গেল চোখ।
চারপাশে শুধু শাল-পলাশ আর নানা আগাছার জঙ্গল। বুনো ফুলের মেলা। প্রাণ জুড়ানো হাওয়ায় ভেসে আসছে দোয়েলের মিঠে শিস। সামনে অনেক নীচে মাইলের পর মাইল সমতলভূমি। ছড়ানো দেশলাই বাক্সের মতো দেহাতি গ্রাম। দূরে কোয়েল নদী বাঁকা এক টুকরো রুপোর পাতের মতো চকচক
করছে। সেই সাথে মাইলের
পর মাইল পাহাড়ের ঢেউ খেলানো রেঞ্জ।
হাঁ করে দেখছিলাম। পাশে বসে আরামে ঢেঁকুর তুলে পান চিবোচ্ছিলেন মাকুমামা। হঠাৎ বললেন,
‘হ্যাঁ রে ফুচে, ঝগড়ুর রান্নাটা কিন্তু দারুণ!
দিন কয়েক এমন চালাতে পারলে আর দেখতে হবে না।’
আমি নেচে উঠে বললাম, ‘যা বলেছ মামা। তারপর চারপাশের সিনারিটাও একবার দ্যাখো!’
কিন্তু সে সব বোধ হয় কানেই গেল না ওঁর। কতকটা স্বগতোক্তির মতো বললেন, ‘ঝগড়ুর চেহারাটাও একবার দেখেছিস? কেমন কিং কং টাইপের। তেমন
বেকায়দায় পড়লে ম্যানেজ করে নিতে পারবে। তাই না রে?’
বুঝতে বাকি রইল না, ঝগড়ুর এক বেলার মুরগির অ্যাকশনেই কাত হয়ে গিয়েছেন মাকুমামা। উৎসাহ দিয়ে বললাম, ‘খুব পারবে। তা ছাড়া বাংলোয় একটা বন্দুকও তো রয়েছে দেখলাম। হাতের কাছে রাখলে ভাবনা কী?’
আমার কথাগুলো দেখলাম বেশ পছন্দ হয়েছে মাকুমামার। এক গাল হেসে বললেন, ‘কালকে ফেরার ব্যাপারটা তাহলে বাতিল করে দিই। কি বলিস? তুই বরং ঝগড়ুকে বলে আয় এবেলাও যেন কচি দেখে গোটা দুই মুরগির ব্যবস্থা করে
রাখে।’
দিন কয়েক যে কীভাবে কেটে গেল কী বলব! যাকে বলে বাদশাহি হাল। মাকুমামার মতো নিতান্ত নীরস মানুষের পেট থেকেও দেখি রীতিমতো
কবিতা বের হতে শুরু করেছে। সারা
দিন শুধু খাওয়া আর ঘুম। এ ছাড়া
সকাল সন্ধে বাংলোর হাতায় বসে প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ। বলা বাহুল্য, দু’জনের কেউই ইতিমধ্যে বাংলোর বাইরে আর পা বাড়াইনি। ঝগড়ু রোজই অভয়বাক্য শোনায়, নেতারহাটের জঙ্গলে দু-চারটে বাঘ থাকলেও তারা মোটেও মানুষের ধারের কাছে ঘেঁষে না। এখানে ওই ভালুকই যা বিপজ্জনক। তবে সেও সেই ফাল্গুন-চৈত্র মাসে মহুয়া ফুলের সময়। সুতরাং আমরা নির্ভয়ে সকাল বিকেল চারপাশটা একটু বেড়িয়ে
আসতে পারি।
মাকুমামা অবশ্য ঝগডুর কথায় একেবারেই কর্ণপাত করেননি। আমাকেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন, ‘খবরদার ফুচে, নাবালক
ছেলে তুই। ওসব কথায় কান দিসনি
একদম।’
সত্যি বলতে কী, মামার অবাধ্য হইনি আমিও। কিন্তু তবু ঘটল ব্যাপারটা। সেদিন দুপুরে ঝগড়ু বাংলোয় নেই। রাত্তিরে বুনো মুরগির ঝোল–ভাত খাবার ইচ্ছে মাকুমামার। সেই খোঁজেই বের হয়েছে। দুপুরে ভূরিভোজের পর বাংলোর হাতায় বসে চারপাশের দৃশ্য
দেখছি। মাকুমামার চেয়ারের
পাশে যথারীতি বন্দুকটা মজুত। আমার
সেদিনের পরামর্শটা বেশ মনে ধরেছে ওনার। বাইরে
এসে বসলেই সর্বক্ষণ পাশে রাখেন। দিব্যি
ফুরফুরে হাওয়া। হাতার বাইরে মস্ত
এক মহুয়া গাছ। জাঁদরেল আকারের
ঝুঁটি ওয়ালা এক বুনো মোরগ অনেকক্ষণ ধরে তার ডগায় বসে কঁক্–কঁক্ শব্দে সমানে ডেকে
চলেছে। জুলজুল চোখে সেদিকে
তাকিয়ে মেজাজে মামা সবে একটু গুনগুনিয়ে উঠেছেন।
আয় রে এবার কাছে আয়, মুরগি ওরে ভাই।
ঝগডুবাবার হাতে আয়, মনের সুখে খাই।
শুধু মাকুমামা নয়‚ দূরে চকচকে কোয়েল নদীর দিকে তাকিয়ে আমার ভিতরেও কেমন কবি-কবি ভাব। বুঁদ
হয়ে দেখছি। আমাদের ডানদিকে
বাংলোর হাতার বাইরে গাছপালার ফাঁকে ঘন ঝোপঝাড়ে ভরা এক টুকরো জঙ্গল। ভিতরটা প্রায় অন্ধকার। হঠাৎ সেখান থেকে খচমচ আওয়াজ হতেই দারুণ চমকে ঘাড় ফেরালেন
মাকুমামা। তারপর ‘খেয়ে ফেল্লে’ বলে মুহূর্তে
এক তুড়ুক লাফ।
চমৎকার একটা কবিতার আইডিয়া তখন আমার ভিতরেও এসে গেছে। মুহূর্তে সেসব কোথায় হাওয়া হয়ে গেল। তাকিয়ে দেখি, ভুসো কালোমতো কী একটা প্রাণী ঘোঁৎ-ঘোঁৎ আওয়াজে সেই গাছপালার
ফাঁকে এগিয়ে আসছে। মাকুমামার
ওই ভয়ানক লাফে পিলে-টিলে আগেই
চমকে গিয়েছিল। গলা
দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এল, ‘মামাগো,
ভালুক!’
কিন্তু কোথায় মাকুমামা! তাকিয়ে দেখি ততক্ষণে তিনি বাংলোর চৌহদ্দি টপকে
সামনে ঢালু জমির ঝোপঝাড় ভেঙে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছেন। হাতে সেই বন্দুক। অগত্যা দেরি না করে আমিও ছুটলাম পিছনে। এবড়োখেবড়ো ঢালু জমি নীচে আরও গভীর জঙ্গলের দিকে নেমে গেছে। হোঁচট খেতে-খেতে কোনওমতে তাকে ধরে ফেলে বললাম, ‘মামাগো, এ যে জঙ্গলের দিকে চলেছ!’
এতটা পথ দৌড়ে মামা তখন হাপরের মতো হাঁপাচ্ছেন। ছুটতে ছুটতেই খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘মেলা ফ্যাচ–ফ্যাচ করিসনি
ফুচে। তোকে তখনই বলেছিলাম, ফিরে যাই। এখন বাঁচতে চাস তো শিগগির ঢুকে পড় এখানে।’
বেশি বলতে হল না। সামনেই ঢালু পাহাড়ের গায়ে মস্ত এক গুহার মুখ। তিন লাফে মাকুমামাকে টপকে গোড়ায় আমিই ঢুকে পড়লাম। ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। পিছনে মাকুমামাও ততক্ষণে ঢুকে পড়েছেন ভিতরে, ‘ফুচে রে, এগিয়ে চল শিগগির।’
কিন্তু এগোব কী! আলো থেকে আসার জন্য চোখ তখন এমন ধাঁধিয়ে গেছে যে, এক
আঙুল দূরের জিনিসও দেখতে পাচ্ছি না। প্রায় হাতড়াতে হাতড়াতে সামান্য এগিয়েছি, হঠাৎ ফোঁৎ করে খানিকটা গরম বাতাস গায়ে এসে
লাগল। সেই সাথে একটা বিশ্রী
বুনো গন্ধ। এদিকে মাকুমামা
সমানে পিছন থেকে খোঁচাচ্ছেন। আমি
বললাম, ‘মামাগো, বিচ্ছিরি গন্ধ।’
শুনে প্রায় খেঁকিয়ে উঠলেন উনি, ‘জঙ্গলে গুহার ভিতরে তোর জন্য গোলাপজল ছড়ানো
থাকবে নাকি হতভাগা!'
আমাকে ঠেলে ফেলে পাশ কাটিয়ে মামা নিজেই এগিয়ে গেলেন
এবার। আর সেই মুহূর্তেই, ঘুঁক্-ঘুঁ–র্–র্–র্।
গাঢ়
অন্ধকারের ভিতর এক রাশ মুলোর মতো দাঁত ক্যামেরার ফ্লাস–গানের
মতো ঝলসে উঠল যেন। মাকুমামা
ততক্ষণে ভিতরে এগিয়ে গিয়েছেন আরও। নিমেষে
ঘুরে দাঁড়িয়ে এক ধাক্কায় আমাকে প্রায় ছিটকে ফেলে হুড়মুড় করে ছুটে বের হলেন।
ওফ্! মাকুমামার ওই নাড়ুগোপাল মার্কা শরীরে এত শক্তি কে জানত! এক ধাক্কায় প্রায় চিৎপটাং। কোনোক্রমে উঠে ল্যাংচাতে ল্যাংচাতে বাইরে বের হতেই ঘোঁৎ-ঘোঁৎ করে গুহার ভিতর থেকে দাঁত খিঁচিয়ে তাড়া
করে এল মস্ত এক ভালুক। কী
সর্বনাশ! এক ভালুকের তাড়ায় পালিয়ে
এসে আর একটার প্রায় কোলে গিয়ে উঠেছিলাম!
ওদিকে মাকুমামা ততক্ষণে বনবাদাড় ফুঁড়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে
দৌড়চ্ছেন। পড়ি কী মরি করে
আমিও ছুটলাম পিছনে। কিন্তু ঝোপঝাড়
ফুঁড়ে ওইভাবে কতক্ষণ আর দৌড়নো যায়? পিছনে ভালুকটা সমানে তাড়া করে আসছে। ব্যাপার বুঝে মাকুমামা হঠাৎ সামনে একটা গাছ পেয়ে তড়বড়িয়ে
উঠতে শুরু করলেন।
‘ফুচে, তুইও উঠে পড় শিগগির। কুইক্।
ততক্ষণে মাকুমামা প্রায় মগডালে উঠে পড়েছেন। এদিকে প্রায় পোস্টের মতো লম্বা ইউক্যালিপ্টাস গাছ। তার মসৃণ গুঁড়ি বেয়ে মাকুমামা কাঠবেড়ালির মতো নিমেষে
মগডালে পৌঁছে গেলেও আমার গাছে ওঠা অভ্যাস নেই। গুঁড়ির অর্ধেক উঠতেই হেদিয়ে গেলাম। হাত-পায়ে খিল ধরে এল। ছাল–টাল উঠে একাকার। এমন সময় মাকুমামা উপর থেকে কোঁ-কোঁ করে উঠলেন, ‘ফুচেরে,
তাড়াতাড়ি এসে আমায় একটু চেপে ধর বাবা। আমার হাত-পা কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে আসছে।’ মামার গলা
প্রায় মৃগী রোগীর মতো শোনাল।
উপরে তাকিয়ে দেখি মাকুমামার হাতে তখনও বন্দুকটা সেই ভাবেই
ধরা। চেঁচিয়ে বললাম, ‘মামা, গুলি, গুলি চালাও এখুনি।’
‘খেপেছিস!’ কোঁকাতে-কোঁকাতে বললেন তিনি, ‘হেভি বোরের বিলিতি জিনিস এসব। মাটিতে দাঁড়িয়ে ছুঁড়লেই শরীরের হাড়গোড় সব আলাদা হয়ে
যেতে চায়, আর গাছে বসে! বাঁটের এক গুঁতোয় কোথায় ছিটকে ফেলবে ঠিক আছে! হতচ্ছাড়াটাকে
সেই থেকে ফেলতেও পারছি না। আঙুলগুলো
কেমন এঁটে গেছে দ্যাখ!’
আমি হেঁচড়ে-পেঁচড়ে ফের উঠবার চেষ্টা করতে গিয়ে উলটে খানিক পিছলে গিয়ে খাবি খেয়ে বললাম,
‘মামাগো, আমি উঠতে পারছি না।’
উপর থেকে মাকুমামা হঠাৎ ভেউ-ভেউ করে কেঁদে উঠলেন ওই সময়, ‘ফুচে রে, ওটা যে গাছ বেয়ে উঠতে লেগেছে। তাড়াতাড়ি এসে আমায় একটু চেপে ধর বাবা। নির্ঘাত আমার সাথে কোলাকুলিটা সেরেই ফেলবে এবার। অন্ধকারে তখনই নুলো বের করেছিল। আমি পালিয়ে এলুম।’
এরপর আর শুধু মাকুমামাই নয়, সত্যিকারের হাহাকার আমার গলা দিয়েও বেরিয়ে
এল। ভালুকটা গাছ বেয়ে
উঠছে মানেই মামা নয়, তার আগে বারোটা
বাজবে আমারই। মুহূর্তে
মাথা ভোঁ-ভোঁ করে উঠল। বোধ হয় পড়েই যেতাম। হঠাৎ দূর থেকে পরিচিত গলায় চিৎকার শুনে ধড়ে যেন প্রাণ
ফিরে এল, ঝগডু সিং।
তাকিয়ে দেখি হাতে মস্ত এক লাঠি নিয়ে প্রায় একটা ভালুকের
মতোই ছুটে আসছে সে। হাতের লাঠিখানা
বন্–বন্ করে ঘোরাতে-ঘোরাতে বিকট শব্দে চিৎকার করছে, ‘হা-লে-লে-হু-র্-র্-হা–আ–আ…
চিৎকার তো নয়, যেন গোটা কয়েক জেট ইঞ্জিনের গর্জন! ঝগড়ুর সেই চিৎকারের
গুনেই হোক, অথবা লাঠির দৌলতে, হঠাৎ দেখি
ভালুকটা গাছ থেকে নেমে পালাচ্ছে। সাহস বটে লোকটার! স্রেফ লাঠি হাতেই এবার সে তাড়া করল জানোয়ারটাকে। ততক্ষণে গাছপালা ভেঙে ভালুকটা ভোঁ দৌড়। আপদটাকে বিদেয় করে একটু বাদেই ফিরে এল ঝগডু। হাত বাড়িয়ে প্রায় চ্যাংদোলা করে নামিয়ে আনল আমাকে, ‘বহুৎ বাঁচিয়ে গেছেন বাবু। লেকিন আপনেরা হামাকে দেখিয়ে ভাগলেন কেনো? হামি তখুন মোর্গা লিয়ে আসতেছিলম তো!’
আমি কিছু বলার আগেই উপর থেকে মাকুমামার গলা শোনা গেল, ‘অ্যা! জঙ্গলের ভিতর দিয়ে
তুই আসছিলি তখন?’
খইনি টেপা দাতে একগাল হাসল ঝগড়ু, ‘জি হাঁ সাহাব। বহুত বঁড়িয়া চিজ মিলিয়েছে আজ। বিলকুল জংলি মোর্গা। নামিয়ে আসেন ঝটপট।’
কিন্তু গাছ থেকে নেমে আসার কোনও লক্ষণই দেখালেন না মাকুমামা। কাঁপা গলায় শুধু বললেন, ‘ঝগড়ুরে, লক্ষ্মী বাপ
আমার। স্ট্যান্ডে গিয়ে
একবার খোঁজ নিয়ে আয় তো বিকেলে রাঁচি ফেরবার কোনও গাড়ি-টাড়ি আছে কিনা।’
ছবি: দিলীপ দাস
প্রথম প্রকাশ: ‘শুকতারা’ পৌষ ১৩৯০