Sunday 9 March 2014

ভাললাগা গল্প (মোবাইল ভার্শন): প্রভু–ভৃত্য–সংবাদ (পরিতোষকুমার চন্দ্র)

ছেলেবেলার ভাললাগা গল্প:
প্রভু-ভৃত্য-সংবাদ
পরিতোষকুমার চন্দ্র
মীরজুমলা সাহেব একজন ব্যারিস্টার। শ্বশুর মহাশয়ের পয়সায় বিলেত থেকে ব্যারিস্টারি পাস করে এসেছিলেন, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। পসার তেমন জমাতে পারেননি। শশুর মহাশয় তার মেয়েকে মানে ব্যারিস্টার সাহেবের বিবিকে কিছু সম্পত্তি দিয়ে গিয়েছিলেন। তারই আয় ও নিজের যৎসামান্য রোজগার, এই দুই মিলিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। সুখের বিষয় ব্যারিস্টার সাহেবের ছেলেপুলে ছিল না। তিনি, তাঁর বিবি ও বিবির বাপের বাড়ী থেকে আনা একটি চাকর, নাম গফুর। যা আয় তাতে এই তিনজনের কোন রকমে কষ্টেসৃষ্টে দিন চলে। ব্যারিস্টার সাহেবের বিবির স্বাস্থ্য ভালো নয়, নিত্যদিন একটা না একটা রোগ লেগেই আছে। গফুরই সব কাজ করে। সে-ই একাধারে বাবুর্চি, খানসামা, চাপরাসীসব কিছুই
ভালো পসার না থাকলেও মক্কেলের প্রত্যাশায় ব্যারিস্টার সাহেব রোজই হাইকোর্টে যান। বিলেত-ফেরত ব্যারিস্টার, তাই বিলেতবাসীদের মতই লাঞ্চ অর্থাৎ দুপুরের খানা খান। নামে লঞ্চ হলেও ব্যারিস্টার সাহেবের বাড়ী থেকে আসে খানকতক রুটি, একটুখানি নিরামিষ ঘ্যা, কিছুটা ডাল, আর ব্যারিস্টার সাহেবের প্রিয় কুঁচে মাছ, অভাবে অন্য কোন কুচো মাছের একটা তরকারি। কড়া করে পেঁয়াজরসুনলঙ্কা দিয়ে রাঁধা। হাইকোর্টের বার লাইব্রেরী,অর্থাৎ ব্যারিস্টার সাহেবদের বসবার যে ঘর তারই পাশে একটা ঘরে পর্দা দিয়ে ঘেরা ছোট ছোট খোপ। তারই একটা নির্দিষ্ট খোপে বসে ব্যারিস্টার সাহেব লাঞ্চ খান। তিনি গফুরকে সেই ঘরের সেই নির্দিষ্ট খুপরিটি কেবল দেখিয়ে দিয়েছিলেন। হাইকোর্ট বাড়ীটার আর কোথায় কি আছে গফুর তা দেখেনি, এমন কি তা দেখবার জন্য কোন রকম আগ্রহও প্রকাশ করেনি। অত বড় পেল্লায় বাড়ীটা দেখে তার বুকটা ধড়মড় করে উঠত। হাইকোর্ট খোলা থাকলে রোজ একটা নির্দিষ্ট সময়ে গফুর টিফিন-কেরিয়ারে করে সাহেবের লাঞ্চ এনে নির্দিষ্ট খুপরিতে রেখে সাহেবের জন্য অপেক্ষা করত। সাহেব এক সময়ে এসে খানা খেয়ে যেতেন, আর গফুর এটো বাসনপত্র নিয়ে বাড়ী ফিরে যেত।
একদিনকার ঘটনা। সেদিন বিবিসাহেব বাপের বাড়ী গেছেন। গফুর রান্নাবান্না শেষ করে নিজে খেয়ে ব্যারিস্টার সাহেবের খানা টিফিন কেরিয়ারে সাজিয়ে শিকের ওপরে তুলে রেখে পাশের বাড়ীর চাকর কাসেমের সঙ্গে একটু গপ্পসপ্প করতে গেছে। কিছুক্ষণ আডডা মেরে বাড়ী ফিরে গফুর দেখে সর্বনাশ। কি করে শিকে ছিঁড়ে টিফিন-কেরিয়ার মাটিতে পড়ে খুলে আছে, আর একটা কেঁদো
বেড়াল ব্যারিস্টার সাহেবের প্রিয় খাদ্য কুঁচে মাছের শ্রাদ্ধ করছে। বেড়ালকে তাড়াতে হোল না, গফুরকে দেখেই চম্পট দিলে। কিন্তু সে এখন কি করে? ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সাহেবের খানা নিয়ে যেতে হবে। বাড়ীতে যা আনাজ আছে তা দিয়ে একটা ঘাট বা তরকারি রেধে নেওয়া যায়। ডালও একটু ফুটিয়ে নেওয়া যায়, কিন্তু মাছ? সাহেব কোর্টে যাবার সময় দেখে গেছেন বাজার থেকে কুঁচে মাছ এসেছে। লাঞ্চ খাবার সময় তার প্রিয় সেই কুঁচে মাছ না দেখতে পেয়ে তাকে তিনি কি আর আস্ত রাখবেন?
 অত বেলায় বাজারে কুঁচে মাছ পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ, আর পাওয়া গেলেও সময় কোথায়? বাজারে গিয়ে মাছ কিনে বাড়ী ফিরে সেই মাছ কুটে রান্না করে এবং সেই সঙ্গে অন্য কিছু তরকারি ও ডাল বেঁধে সাহেবের লাঞ্চ নিয়ে যেতে যাকে বলে সেই বেলা তিনটে। মেমসাহেব বাপের বাড়ী, একটু যে পরামর্শ করবে তারও উপায় নেই। গফুর লুঙ্গী ছেড়ে একটা পাজামা পরে নিল, তার ওপরে চড়াল একটা হাতকাটা শার্ট, আর কাধে ফেলল একটা তোয়ালে। তারপর ছুটল হাইকোর্টের দিকে। সাহেবকে বিপদের কথা আগে তো জানাই, তারপর তিনি যা বলবেন তাই করা যাবে।
সাহেবের একমাত্র খানাঘর ছাড়া গফুর হাইকোর্টের আর কোথায় কি আছে তা আগে দেখেনি। এখন তাই বেশ একটু মুশকিলে পড়ল। তবু নিরাশ না হয়ে বা ঘাবড়ে না গিয়ে একে ওকে জিজ্ঞাসা করে করে কোন রকমে বার লাইব্রেরীতে এসে পৌঁছল। দরজা দিয়ে উকি মেরেই গফুর কিন্তু বেজায় ঘাবড়ে গেল, কারণ সেই ঘরে যতজন ব্যারিস্টার ছিলেন সবাই একই রকম পোশাক পরে বসে আছেন সুতরাং গফুরের কাছে সবাই যেন এক, অর্থাৎ সবাই তার মনিব। সে এখন কি করে? সেই একই রকম দেখতে সব কজন সাহেবের মধ্য থেকে তার মনিব মীরজুমলা সাহেবকে খুঁজে বার করতেই হবে এবং তা তাড়াতাড়ি। মনে মনে একটা মতলব ঠিক করে গফুর কপাল ঠুকে ঘরে ঢুকে পড়ল তারপর সেলাম করার ঙ্গীতে কপালে ডান হাত ঠেকিয়ে সবাই যেন শুনতে পায় এমনি জোর গলায় বলল: সব সাহেবকো এক সেলাম। বালিস্টার মীরজুমলা সাব কিকো নাম?
সব কজন ব্যারিস্টারকে আলাদা আলাদা ভাবে সেলাম জানাতে গেলে বেলা গড়িয়ে যাবে, তাই গফুর এই ভাবে একটিমাত্র সেলামে সব কজনকেই সেলাম জানিয়ে খাতির জানালে।
যাহো, কোনদিনই যাকে বার লাইব্রেরী দেখান হয় নি, এমন কি সেটা কোনদিকে কোনখানে তা জানানও হয় নি, তাকে এই অসময়ে এই ভাবে সেই ঘরে ঢুকতে দেখে মীরজুমলা সাহেব বেশ একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন বাড়ীতে কোন কিছু দুর্ঘটনা ঘটল নাকি? তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আত্মপ্রকাশ করে ব্যগ্রভাবে গফুরকে জিজ্ঞাসা করলেন : কেয়া খবর গফুর ?
সাহেবকে দেখতে পেয়ে গফুর তাকে এবার একক ভাবে আলাদা একটা সেলাম জানিয়ে বলল : সেলাম হুজুর, বহুত খারাব খবর লেকে আয়া হুঁ। বিলাইতসে দুশমন আকর কুঁচলি পরগনা লুঠ লিয়া।
মীরজুমলা সাহেব গফুরের ঠারের কথায় বুঝতে পারলেন যে, বিল্লি অর্থাৎ বেড়াল এসে কুঁচে মাছ খেয়ে গেছে। কিন্তু কি করে? তিনি জানেন, মাছ রান্না করার পর রোজই শিকেয় তুলে রাখা হয়। সেদিনও মাছ শিকেয় তুলে রাখা হয়েছিল কিনা তা জানবার উদ্দেশ্যে তিনি গফুরকে জিজ্ঞাসা করলেন: কেইসে লিয়া? শিক্যা সিং নেহি রোকা?
শিকে যে ছিড়ে পড়ে গেছে তা জানাবার জন্য গফুর ফের আর একবার সেলাম জানিয়ে বলল: হুজুর, উনহি তো পহিলা চোটমেই পটক গিয়া।।
টিফিন-কেরিয়ারে খাবার ভরে শিকেয় তোলা থাকে। শিকে ছিড়ে পড়ে গেলেও টিফিন–কেরিয়ার তো বন্ধই থাকবে। তা যদি হয় তবে বেড়াল মাছ খেল কি করে তা জানবার জন্য মীরজুমলা সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন: ঢাকল সিং তো হাজির থা!
মুখ বিষন্ন করে গফুর উত্তর দিল: উনহিতো হুজুর নিমকহারামি কিয়া।
মীরজুমলা সাহেব উত্তর শুনে এমন চিন্তামগ্ন হয়ে পড়লেন যেন কি সাংঘাতিক একটা কিছু ঘটেছে। তিনি অনবরত গালে হাত বুলোতে লাগলেন। সাহেব কিছু বলেন না দেখে খুব বিনয় সহকারে গফুর জিজ্ঞাসা করল: আব হাম কেয়া করেঙ্গে হুজুর?
মীরজুমলা সাহেব মৌনতা ভঙ্গ করলেন। মাছের কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা তা জানবার জন্য জিজ্ঞাসা করলেন: হুঁয়া পর আউর কৌন কৌন হ্যায়?
গফুর জানাল। লেজা সিং আউর শিরখা, অর্থাৎ কেবল ল্যাজা-মুড়ো পড়ে আছে।
মীরজুমলা সাহেব এবার একটু চাঙ্গা ভাব দেখিয়ে বললেন: তুম তুরন্ত যাকর লেজা সিং শিরখাঁকো ভাগা দেও। আউয় বায়গনপট্টি খানাসে মুশরি খাঁকে বোলাকে লে আও
অর্থাৎ এখুনি বাড়ী ফিরে মাছের ল্যাজা-মুড়ো ফেলে দাও। আর তাড়াতাড়ি বেগুনপোড়া ও মুশুরি ডাল রেঁধে নিয়ে এসো।
মীরজুমলা সাহেব ও তার চাকর গফুরের মধ্যে এই ভাবে যে সাটের কথা হয়েছিল, ন্যে তা বুঝতে পেরেছিল কিনা বলতে পারি না। তবে এটা বেশ জানি যে, তারা পরস্পর পরস্পরের ইঙ্গিত বেশ বুঝতে পেরেছিল, কারণ সাহেবের শেষ আদেশ শোনার পর গফুর আর একবার সেলাম করা সঙ্গে ‘যো হুকুম হুজুরবলে চলে গিয়েছিল। তারপর একটু দেরী হলেও শেষ পর্যন্ত সাহেবের অত ভুলুন্ঠিত রুটি, বেগুনপোড়া ও মুশুরি ডালের লাঞ্চ এনে দিয়েছিল।

ছবি: প্রকাশ গুপ্ত


6 comments:

  1. এখনও দারুণ লাগলো

    ReplyDelete
  2. চমৎকার লাগল। এরকম একটি গল্প ছোটবেলায় মায়ের মুখে শুনেছিলাম। এক রাজার অসুখ করেছিল। কবিরাজ যে ওষুধ দিলেন তার অনুপান ছিল খুদের জাউ। সূপকার সেই জাউ রান্না করে রাজাকে খবর দিত। রাজা রান্নাঘরে এসেই সেই জাউ খেয়ে যেতেন। একদিন রাজার কাছে বিদেশ থেকে দূত এসেছে রাজা তার সাথে কথা বলতে ব্যস্ত খুদের জাউ খেতে যাবার কথা তাঁর মনে নেই। এদিকে সূপকার আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? শেষে সে রাজদরবারে গিয়ে নিবেদন করল, "মহারাজ, চালমণির পুত্র খুদমণি রায় মহারাজা সে আপনার সংগে দেখা করতে চায়।" রাজা ইঙ্গিত বুঝে উত্তর দিলেন "তিনি আছেন কোথায়?" সূপকার বলল "পাথুরিয়া দেশে কাঠির তাড়নায়, রাজামশাই না এলে সে জুড়ান্তিপুর যায়"। রাজামশাই অতিথির অনুমতি নিয়ে জাউ খেতে গেলেন।
    উপেন্দ্রকিশোরেরও এরকম একটি গল্প আছে। তবে সেটা চাকরের বুদ্ধিমত্তার প্রসঙ্গে। ধনীর গৃহে দাওয়াত হচ্ছে। গৃহকর্তার দাড়িতে পোলাওয়ের ভাত লেগে আছে। তিনি টের পাচ্ছেন না। চাকর তখন গানের সুরে গুনগুনিয়ে বলল "ফুলের তলে বুলবুল ছানা তাকে উড়িয়ে দে না উড়িয়ে দে না। মনিব বুঝতে পেরে দাড়ি থেকে ভাত ঝেড়ে ফেলে দিলেন।
    তাতে অবশ্য বর্তমান লেখাতির গুণ বা মূল্য কোনটাই কমে না।

    ReplyDelete
  3. ধন্যবাদ‚ চমৎকার নতুন গল্প শোনাবার জন্য। ভাল থাকবেন।

    ReplyDelete