Wednesday 2 January 2019

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোঃ ভাঃ): পিন্টু (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়)


পিন্টু
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়
মার একটা দু’নলা বন্দুক আছে। বারো বোরের বন্দুক, ব্রীচ লোডিং অর্থাৎ গাদা বন্দুক নয়। দিশী মিস্ত্রী এই বন্দুক তৈরি করেছে কিন্তু এত সুন্দর জিনিস যে বিলিতি বন্দুকের চেয়ে কোনো অংশে খারাপ নয়। দেড়শো গজ পর্যন্ত তার পাল্লা। পয়েন্ট ব্ল্যাংকে দিয়ে স্বচ্ছন্দে হাঁস মারা যায়, যদিও এটা হাঁস-মারা বন্দুক ডাক গান নয়। এই বন্দুকটি আমার বড় প্রিয়।
পাখি শিকার করতে আমি বড় ভালবাসতুম। শীতকালে যখন খালে বিলে নানা জাতের হাঁস পড়তে আরম্ভ করত তখন আমি বন্দুক কাঁধে করে বার হতুম। সে সময় আমার সঙ্গী থাকত কেবল আমার কুকুর পিন্টু। পিন্টু, খাঁটি দিশী কুকুর। তার গায়ে এক ফোঁটাও বিলিতি রক্ত ছিল না, ইচ্ছে করলে তোমরা তাকে নেড়ি কুত্তাও বলতে পার। তার চেহারাটি ছিল রোগা। গায় সাদা-কালো ছাপ, মুখটি ছুঁচলো, চোখে একটি লজ্জিত সঙ্কুচিত ভাব। সত্যি কথা বলতে কি, পিন্টু খুব সাহসী কুকুর ছিল না। ভিনপাড়া দিয়ে যাবার সময় তার ল্যাজটি অলক্ষিতে পিছনের পা দুটির ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করত, আর পাড়ার কুকুরগুলো যখন ঘেউ ঘেউ করে তেড়ে আসত তখন সে কেবলি আমার পাশে ঘেঁষে ঘেঁষে আসত, আর গলার মধ্যে ‘গর্র—গর্র’ শব্দ করত। দাদা বলতেন, শুধু দুধ-ভাত খেয়ে খেয়েই পিন্টুর সব সাহস মিইয়ে গেছে। কিন্তু সে যাই হোক, পিন্টুর একটি অসাধারণ গুণ ছিল। সে খুব ভালো মরা পাখি উদ্ধার করতে পারত। গুলি খেয়ে উড়ন্ত পাখি যেখানেই পড়ুক জলে স্থলে কিম্বা পাঁকের মধ্যে পিন্টু, ঠিক তাকে মুখে করে নিয়ে আসবে। ইংরেজিতে এই জাতের কুকুরকে বলে রিট্রিভার। একবার এক সাহেব পিন্টুর আশ্চর্য গুণপনা দেখে দুশো টাকা দিয়ে আমার কাছ থেকে কিনে নিতে চেয়েছিল। আমি দিইনি।
যাহোক, শীতকাল এলেই আমরা দু’জনে শিকারে বার হতুম। এমন অনেকবার হয়েছে যে, পাখির সন্ধানে ঘুরতে ঘুরতে বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে গিয়েছি, দু’তিন দিন বাড়ি ফেরাই হল না। আমার শিকারের শখ বাড়ির সকলে জানতেন, তাই উদ্বিগ্ন হতেন না।
গত বছর শিকার করতে গিয়ে কি ব্যাপার হয়েছিল সেই কথাই আজ বলব।
খবর পেলুম, শহর থেকে মাইল কুড়ি দূরে যে জলা আছে তাতে বিস্তর হাঁস পড়েছে। হাঁসগুলো আশেপাশের ধানক্ষেতের ক্ষতি করছে। মন উৎসুক হয়ে উঠল। অঘ্রাণ মাস বেশ শীত পড়েছে। একদিন সকালবেলা পিন্টুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়লুম। অজ পাড়াগাঁয়ে গাড়ি যাবার রাস্তা নেই যেতে হলে এক গরুর গাড়ি চড়ে যেতে হয়। আমরা পায়ে হেঁটেই গেলুম, কারণ গরুর গাড়ি চড়ে কাঁচা রাস্তার ওপর দিয়ে বিশ মাইল যাওয়ার চেয়ে হেঁটে যাওয়া ঢের বেশী স্বাস্থ্যকর। অন্তত হাড়গুলো আস্ত থাকে।
জলার নিকটবর্তী গ্রামে গিয়ে যখন পৌঁছলুম তখন সন্ধ্যা হয় হয় পশ্চিম আকাশে একটুখানি সোনালী আলো ঝিলমিল করছে। দূর থেকেই অসংখ্য হাঁসের কলকণ্ঠ শুনতে পাচ্ছিলুম। হাঁসের ডাক সকলের ভালো লাগে কিনা বলতে পারি না, কিন্তু আমার বড় মিষ্টি লাগে। দেহের ক্লান্তি সত্ত্বেও মনটা আনন্দে নেচে উঠল। পিন্টুও আমাকে ঘিরে আনন্দে নাচতে লাগল আর ঘেউ ঘেউ করে ডাকতে লাগল।
গ্রামে বেশীর ভাগই নিম্নশ্রেণীর লোকের বাস কিন্তু একটি ছোট্ট পোস্ট অফিস ছিল। তারই পোস্টমাস্টারের বাড়িতে আতিথ্য স্বীকার করলাম। তিনি ভারি ভদ্রলোক। গরম চা এবং প্রচুর জলখাবার দিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা করলেন। গরম গরম খাদ্যদ্রব্য পেটে পড়তেই শরীর বেশ চাঙ্গা হয়ে উঠল।
নানারকম কথাবার্তায় ক্রমে রাত্রি হয়ে গেল, পুবের আকাশ উদ্ভাসিত করে পূর্ণিমার চাঁদ উঠল। আমি তখন পোস্টমাস্টারবাবুকে বললাম, এবার বেরুনো যাক। কোন দিক দিয়ে গেলে সহজে জলায় পৌঁছনো যাবে আমাকে দেখিয়ে দিন।
আমার কাঁধে বন্দুক দেখেই পোস্টমাস্টার বুঝেছিলেন যে আমি শিকার করতে এসেছি। কিন্তু আমি সে-রাত্রেই পাখি মারতে বেরুব তা তিনি বুঝতে পারেননি। তিনি আশ্চর্য হয়ে বললেন, ‘রাত্তিরে পাখি মারতে যাবেন?
আমি বললুম, ‘হ্যাঁ রাত্তিরেই তো পাখি মারবার সুবিধা, দেখছেন না কি সুন্দর চাঁদ উঠেছে।’
পোস্টমাস্টার একটু, ভয়ে-ভয়ে বললেন, ‘কিন্তু রাত্তিরে জলার দিকে যাবেন? সন্ধ্যার পর ওদিকে কেউ যায় না।’
‘সেকি! কেন?’
তিনি কুণ্ঠিতভাবে বললেন, ‘কি জানি মশায়, আমি চোখে কিছু, দেখিনি। শুনতে পাই জলায় নাকি অপদেবতা আছেন।’
আমি হেসে উঠলুম, ‘অপদেবতা! সে আবার কি?’
তিনি বললেন, ‘তা জানিনে মশাই, তবে শুনেছি শরবনের মধ্যে। নাকি পেত্নী আছে।’
আমি হাসতে লাগলুম, বললুম, ‘তা থাক পেত্নী। আমার হাতে বন্দুক আছে। দেখলে সে নিজেই ভয়ে পালিয়ে যাবে।’
তিনি মাথা নেড়ে বললেন, ‘যাওয়া বোধহয় উচিত নয়। একবার এক সাহেব আপনারই মত রাত্তিরে জলায় শিকার করতে গিয়েছিল, সে আর ফিরে আসেনি।’
আমি বললাম, ‘কোনো ভয় নেই। আমি এগারোটার মধ্যেই ফিরে আসব। আপনি শুধু আমায় পথটা দেখিয়ে দিন।’
তিনি তখন অনিচ্ছাভরে গাঁয়ের সীমানা পর্যন্ত এসে আমায় জলা দেখিয়ে দিলেন। জলাটা সেখান থেকে মাইলখানেক দুরে। চাঁদের আলো তার ওপর ঝক ঝক করছে আর ধোঁয়ার মত অস্পষ্ট পাখির সারি তার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
চাঁদনী রাতে জলার ধারে কি করে পাখি শিকার করতে হয় তা বোধহয় সকলে জানে না। অথচ ব্যাপারটা খুব সহজ এমন কি দিনের বেলা পাখি শিকার করার চেয়েও সহজ। রাত্রে জলার পাখিরা চোখে ভাল দেখতে পায় না। কিন্তু কেবলই উড়ে বেড়ায়। জলার এধার থেকে ওধারে যায় আবার এধারে ফিরে আসে। তাই, চাঁদ যখন গাছের ডগা ছাড়িয়ে ওঠে তখন সেই চাঁদের দিকে লক্ষ্য রেখে বন্দকে টোটা ভরে কোনো ঝোপের আড়ালে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। পাখির সার যখন চাঁদের কাছ দিয়ে উড়ে যায় তখন চাঁদ লক্ষ্য করে বন্দুক ছুঁড়তে হয়। ছররা খেয়ে পাখিগুলো ধপ্ ধপ্ করে মাটিতে পড়ে তখন কুকুর গিয়ে সেগুলোকে খুঁজে নিয়ে আসে। এ রকম শিকারের সুবিধা এই যে পাখির পিছন পিছন ঘুরে বেড়াতে হয় না। এক জায়গায় দাঁড়িয়েই অনেক পাখি পাওয়া যায়।
যাহোক, আমি আর পিন্টু আলের ওপর দিয়ে জলার দিকে চললাম। বেশ একটু, ঠাণ্ডা বাতাস দিচ্ছে। কিন্তু আমার গায়ে গরম কোট হাফ-প্যান্ট ছিল, পায়ে হোস আর বুটজুতো ছিল, তাই ঠাণ্ডা হাওয়া ভালই লাগল। পকেটে গোটা কুড়ি চার নম্বরের কার্তুজ নিয়েছিলুম। আশা ছিল তাইতেই আজকের মত কাজ চলে যাবে।
ক্রমে জলার কাছে এসে পড়লুম। এখানকার মাটি নরম, মাঝে মাঝে জল সরে গিয়ে আধ-শুকনো পাঁকও রয়েছে। জলাটা প্রকাণ্ড একটা হ্রদ বললেও চলে। কিন্তু জল খুব গভীর নয়। তার কিনারা ঘিরে ঘন শরবন জন্মেছে। মাঝখানেও স্থানে স্থানে শরের গোছা উঁচু হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় সমস্ত দৃশ্যটা এমন অস্পষ্ট হয়ে আছে যেন পৃথিবীর আদিম যুগের তন্দ্রাচ্ছন্ন প্রকৃতির চিত্র। দেখলে প্রাণের ভিতরটা কেমন করে ওঠে।
জলের কিনারা পর্যন্ত যাবার কোনো দরকার ছিল না। চারিদিকে তাকিয়ে দেখলুম কতকগুলো কাঁটাগাছের শুকনো ঝোপ ইতস্ততঃ ছড়ান রয়েছে। তারই মধ্যে একটা বেছে নিয়ে আমি তার আড়ালে গিয়ে দাঁড়ালুম। বন্দুকে টোটা ভরে পাখির জন্যে তৈরি হয়ে রইলুম।
এইবার পিন্টুর চাল-চলন লক্ষ্য করলুম। সে এতক্ষণ বেশ লাফালাফি করতে করতে আমার সঙ্গে আসছিল কিন্তু এখানে এসেই কেমন যেন জড়সড় হয়ে গেল। তার ল্যাজটি করুণভাবে পায়ের মধ্যে প্রবেশ করল, সে শঙ্কিত চোখে এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে একটা ক্ষীণ কুঁই কুঁই শব্দ করতে লাগল।
চারিদিকে চেয়ে দেখলুম, অন্য কোনো কুকুর বা ভয়াবহ কিছুই নেই। ভাবলুম, জলার ধারে ঠাণ্ডা হাওয়ায় নিশ্চয়ই তার শীত করছে, তাই অমন করছে।
খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি, হঠাৎ একটা শব্দ শুনে চমকে উঠলুম। জলার কিনারা দিয়ে একটা খটখট—খটখট শব্দ ক্রমশ আমার দিকে এগিয়ে আসছে যেন একটা বিকট হাসির আওয়াজ! কিন্তু তখনি বুঝতে পারলাম যে অস্বাভাবিক কিছু নয়, শরবনের মধ্যে দিয়ে হাওয়া বইছে। এই খট খট শব্দ ক্রমে আমার পাশ দিয়ে বেরিয়ে চলে গেল দূরে গিয়ে মিলিয়ে গেল, কিন্তু দীর্ঘনিশ্বাসের মত একটা শব্দ তখনো শরবনের ভিতর থেকে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। আমার ভারি হাসি পেল। এইসব শব্দ শুনেই বোধহয় গাঁয়ের লোকেরা ভূত-পেত্নীর ভয়ে এদিকে আসে না।
আবার শব্দ! এবারের শব্দ এমনি অপার্থিব যে শুনে আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। বহুদূর জলার বুক থেকে একটা দীর্ঘ কান্নার সুর, যেন কোনো স্ত্রীলোক কেঁদে উঠল ‘আহা-হা-হা–হা'…।
চারিদিকে প্রতিধ্বনি তুলে এই কান্না ক্রমে ক্ষীণ হয়ে গেল।
জলাতে অনেক রকম অজানা পাখি থাকে, মনে হল হয়তো তাদেরই কেউ অমন করে কেঁদে উঠল। কিন্তু আমি অনেক পাখি মেরেছি, অনেক ঝিলে জঙ্গলে বেড়িয়েছি, এরকম পাখির ডাক কখনো শুনিনি। একবার মনে হল, পাখি বটে তো? পিন্টুর দিকে তাকিয়ে দেখি, সে আমার পা ঘেঁষে এসে বসেছে আর তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। আমি তার পিঠে হাত বুলিয়ে তাকে বললুম, ‘কিছু, ভয় নেই পিন্টু ও পাখির ডাক।’
পিন্টু, করুণভাবে আমার দিকে তাকাল, তারপর ছুটে গাঁয়ের দিকে খানিকটা এগিয়ে গিয়ে আবার ফিরে এসে ব্যগ্র-চোখে আমার পানে চেয়ে রইল। কুকুর কথা কইতে পারে না, কিন্তু পিন্টু যেন পরিষ্কার আমাকে বললে ‘ফিরে চল, এ বড় খারাপ জায়গা, এখানে থেকে কাজ নেই।’
হায়! পিন্টুর কথা যদি শুনতুম!
হাতের ঘড়িতে দেখলুম, সাড়ে নটা বেজেছে। এই সময় আকাশে শন-শন শব্দে মুখ তুলে দেখি এক ঝাঁক পাখি বোধ হয় মোরগাবি। কারণ মোরগাবিরা এত জোরে ওড়ে যে তাদের ডানার সাঁই-সাঁই আওয়াজ হয় চাঁদের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। তৎক্ষণাৎ বন্দুক তুলে ফায়ার করলুম। চারিদিকে একটা বিকট প্রতিধ্বনি উঠল। তারপর ধপ্‌ করে একটা শব্দ হল। বুঝলুম পাখি পড়েছে।
পাখি পড়ার শব্দে পিন্টুর ভয় কেটে গেল। সে কান খাড়া করে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল, তারপর লাফাতে লাফাতে যেদিকে পাখি পড়েছিল সেইদিকে ছুটল।
পাখিটা পঞ্চাশ হাত দূরে একটা ঝোপের মধ্যে পড়েছিল, পিন্টু, সেই ঝোপের কাছাকাছি গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল, তারপর চোঁ-চোঁ করে পালিয়ে এসে আমার জুতোর মধ্যে মুখ লুকিয়ে বসে পড়ল। আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, ‘কি হয়েছে পিন্টু? পালিয়ে এলি যে?’ তার গায়ে হাত দিয়ে দেখি তার ঘাড়ের রোঁয়া কাঁটার মত খাড়া হয়ে উঠছে।
পিন্টু কখনও এ রকম করে না, তাই ভারি আশ্চর্য হয়ে আমি নিজেই সেই ঝোপটার দিকে অগ্রসর হলুম। কাঁটাগাছের ঝোপে পাতা নেই, তার ভিতরে পরিষ্কার চাঁদের আলো পড়েছে। ঝোপের দশ হাতের মধ্যে গিয়ে আমিও থমকে দাঁড়িয়ে পড়লুম। দেখলুম মরা পাখিটা মাটিতে পড়ে রয়েছে, আর সাদা কাপড় পরা একটা স্ত্রীলোকের মূর্তি তার উপর ঝুঁকে পড়ে যেন তাকে আগলে রয়েছে।
এই সময় আবার সেই তীব্র কাতরোক্তি ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল ‘আহা-হা-হা-হা…।’
ভয়ের একটা শিহরণ আমার হাড় পর্যন্ত কাঁপিয়ে দিয়ে গেল। কে ও? মানুষ না আর কিছু? অমন করে কেঁদে উঠল কেন?
প্রাণপণে ভয় দমন করে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কে?’
আবার সেই বুক-ফাটা কান্না ‘আহা-হা-হা-হা…।’
আমি জড়মূর্তির মত দাঁড়িয়ে রইলুম। ইচ্ছে হল পালাই, কিন্তু পালাতে পারলুম না। আমার দুই চোখ সেই ঝোপের মধ্যে নারীমূর্তির ওপর নিবদ্ধ হয়ে রইল।
হঠাৎ নারীমূর্তি উঠে দাঁড়াল ঝোপের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল। আমি তার মুখ দেখতে পেলুম না, সর্বাঙ্গ কুয়াশার মত সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা। সে একটা সাদা হাত তুলে আমায় ডাকলে। তারপর নিঃশব্দে চলে যেতে লাগল।
খানিক দূর গিয়ে সে ফিরে দাঁড়াল, তারপর আবার হাত তুলে আমায় ডাকলে। আমার স্বাধীন ইচ্ছাশক্তি যেন একেবারে লুপ্ত হয়ে গিয়েছিল, কলের পুতুলের মত আমি তার পিছন পিছন চললুম।
পিন্টু এতক্ষণ অনেক দূরে পিছিয়ে ছিল, এবার সে ছুটে এসে আমার পা কামড়ে ধরলে। ভয়ে তার গা কাঁপছে, শরীর যেন কুঁকড়ে ছোট হয়ে গেছে, তবু সে আমায় ফেলে পালাতে পারছে না। আমার পা কামড়ে ধরে পিছন দিকে টানতে লাগল, যেন কিছুতেই আমাকে যেতে দেবে না। কিন্তু চুম্বকের আকর্ষণ লোহাকে যেমন টেনে নিয়ে যায়, আমিও তেমনি অন্ধভাবে সেই মূর্তির অনুসরণ করলুম। পিন্টু পদে পদে বাধা দিতে লাগল, পায়ের কাছে পড়ে কেঁউ কেঁউ করে মিনতি জানাতে লাগল, তবুও আমার গতিরোধ করতে পারল না।
ক্রমে তলতলে নরম পাঁকের ওপর এসে পড়লুম। সে যে কি ভয়ংকর জিনিস তা বর্ণনা করা যায় না। আর এই পাঁকে আস্তে আস্তে ডুবে মরার মত ভয়াবহ মৃত্যুও কল্পনা করা কঠিন। আমি কিন্তু কোথায় যাচ্ছি কিছুই জ্ঞান ছিল না, কেবল সেই মূর্তির দিকে চোখ রেখে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। ক্রমে যখন পাঁকের মধ্যে হাঁটু পর্যন্ত ডুবে যেতে লাগল তখন দাঁড়িয়ে পড়লুম। মূর্তিও সামনে খানিক দূরে দাঁড়াল। তারপর আবার সেই রক্ত-জল-করা আওয়াজ আহা–হা–হা–হা…।
এবার কিন্তু কান্না নয়, মনে হল যেন সে একটা পৈশাচিক প্রতিহিংসার হাসি হাসছে।
আমি আর এগিয়ে যাচ্ছি না দেখে মূর্তি দু’এক পা ফিরে এল, খানিক দাঁড়িয়ে থেকে আবার আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলে। ওদিকে আর বেশী এগোলে এই অতল পাঁকের মধ্যেই ডুবে যাব বেশ বুঝতে পারছি, কিন্তু তবু, ঐ হাতছানি অমান্য করবার সাধ্য নেই। বন্দুকটা এতক্ষণ হাতেই ছিল, এবার ফেলে দিলুম। তারপর পাগলের মত সেই পাঁকের ভিতর দিয়ে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চললুম।
পিন্টু! এই সময় পিন্টু যে অদ্ভুত কাজ করলে তা জীবনে কখনো ভুলব না। সে এতক্ষণ আমার পিছন পিছন আসছিল, কিন্তু যখন দেখলে যে আমি ঊরু, পর্যন্ত কাদায় ডুবে যাচ্ছি তখন সে হঠাৎ একটা বিকট চীৎকার করে আমার সামনে এল। আমি দেখলুম, তার সর্বাঙ্গের রোঁয়া খাড়া হয়ে উঠেছে আর সে হিংস্র ভাবে দাঁত বার করে সেই মূর্তির পানে ছুটে চলেছে।
সাদা মূর্তিটার সামনে পৌঁছে সে কণ্ঠ লক্ষ্য করে তার ঘাড়ের উপর লাফিয়ে পড়ল।  সঙ্গে সঙ্গে একটা আর্ত কম্পিত চীৎকার পিন্টুর কণ্ঠ চিরে বেরিয়ে এল। যাকে লক্ষ্য করে সে লাফ দিয়েছিল সেই মূর্তি হঠাৎ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। পিন্টু কোথাও বাধা না পেয়ে কাদায় পড়ে গেল। আর উঠল না।
‘পিন্টু! পিন্টু!’
আমি আত্মহারার মত ছুটে গেলুম যেখানে পিন্টু পড়ে ছিল। সেখানে পাঁক তত গভীর নয়, তলায় শক্ত মাটি আছে। পিন্টুর নিশ্চল দেহ দু’হাতে তুলে নিয়ে দেখলুম তার দেহে প্রাণ নেই সে মরে গিয়েছে। সেই যে ভয়ার্ত চীৎকার তারই সঙ্গে সঙ্গে পিন্টুর প্রাণবায়ু বেরিয়ে গিয়েছে।
চারিদিকে চেয়ে দেখলুম, সেই সাদা মূর্তি কোথাও নেই যেন জলাভূমি থেকে উত্থিত একটা দুষ্ট বাষ্প আবার জলাভূমিতেই মিলিয়ে গিয়েছে।
‘পিন্টু! পিন্টু!’ বলে তার কাদা-মাখা শরীর বুকে জড়িয়ে নিয়ে আমি অজ্ঞান হয়ে পড়লুম।
পরদিন সূর্যোদয়ের সঙ্গে জ্ঞান হল। তখনও পিন্টুর মৃতদেহ বুকে জড়িয়ে আছি।
সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা আর ১০৫ ডিগ্রি জর নিয়ে একলা বাড়ি ফিরে এলুম।
ক্রমে সেরে উঠলুম। এখনও মাঝে মাঝে শিকারে যাই, কিন্তু আমার পিন্টু নেই, শিকারে মন লাগে না।
যখন মনে হয় পিন্টু আমার প্রাণ বাঁচাতে গিয়ে নিজের প্রাণ দিয়েছে দারুণ ভয়ে তার বুকের স্পন্দন থেমে গেছে কিন্তু তবু, ভালবাসা একতিল কমেনি তখন কান্নায় বুক ভরে ওঠে।
পিন্টু সাহসী কুকুর ছিল না; কিন্তু দরকারের সময় তার মত সাহস ক’জন দেখাতে পেরেছে?
আপলোড: ১৮/৩/২০১৯

4 comments:

  1. Univarsal love towards the master

    ReplyDelete
  2. You tube e Sunday suspense e ei golper shrutirup ache.Setao upobhoggo.

    ReplyDelete
  3. sobkichu miliye osoriri r golpo kivabe biswasjogyo kore tute hoy ei golpoTi tar ek udahoron bole ami manbo.

    ReplyDelete
  4. অসামান্য, ছোটদের হলেও বেশ রোমহর্ষক। কুকুরের প্রভু ভক্তি সর্বজনবিদিত।

    ReplyDelete