Thursday 3 January 2019

ভাললাগা ভৌতিক গল্প (মোবাইল ভাঃ): কঙ্কাল সারথি (হেমেন্দ্রকুমার রায়)

কঙ্কাল সারথি
হেমেন্দ্রকুমার রায়
উঃ ম্যালেরিয়ার মতন ছ্যাঁচড়া অসুখ পৃথিবীতে আর কিছু আছে কি? উঁহু।
এই দ্যাখ না, সখ করে সেদিন ঢাকুরিয়ার ‘লেক’ দেখতে গিয়েছিলাম, সন্ধ্যার একটু আগে। হঠাৎ কাঁপুনি দিয়ে আমার জন্ম এল।
সেকি যে-সে জর, যে-সে কাঁপুনি? না পারি দাঁড়াতে, না পারি বসতে, একেবারে ঘাসের উপর পড়লুম শুয়ে। কী শীত রে বাপ! পা থেকে মাথা পর্যন্ত চাদর মুড়ি দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে কেমন যেন আচ্ছন্নের মত হয়ে রইলুম!
সেই ভাবে কতক্ষণ ছিলম, ভগবান, জানেন। তবে একবার চাদরের ভিতর থেকে জুল-জুল করে চোখ মেলে উঁকি মেরে দেখলুম, চারিদিকে গাঢ় অন্ধকারের মেলা বসেছে, কোথাও জন-মানবের সাড়া নেই!
বুকটা ছাঁৎ করে উঠল। কোথায় বাগবাজারে আমার বাড়ী, আর কোথায় পড়ে আছি আমি, একলা! গণ্ডায় গলায় ছুরি বসাতে পারে, সাপে কামড়াতে পারে, বিনা-চিকিৎসায় প্রাণপাখী ফুডুৎ করে পালিয়ে যেতে পারে! বাড়ীর লোক এতক্ষণে হয়তো ভেবে সারা হচ্ছে!
আর তো এখানে থাকা চলে না! যেমন করেই হোক, আমাকে আজ বাড়ী যেতেই হবে।
অনেক কষ্টে উঠে দাঁড়ালাম। গায়ের ভিতর দিয়ে তখনো যেন আগুনের ঝলক ছুটছে, চোখের সামনে দিয়ে যেন রাশি রাশি সর্ষে ফুল নাচতে নাচতে একবার আঁধার-সাগরে ডুবে যাচ্ছে, আর একবার ভেসে উঠছে! প্রতিবার পা ফেলি আর মনে হয়, এই বুঝি আমি দড়াম করে পপাত ধরণীতল হলুম! তবু, থামলাম না, মাতালের মতন টলতে টলতে এগিয়ে চললাম।
রাত ঝাঁঝাঁ করছে! সেই রাত্রে আমি প্রথম বুঝতে পারলুম, পৃথিবী কত বেশী স্তব্ধ হতে পারে! সহরের হট্টগোলে রাগ হয় বটে, কিন্তু এ স্তব্ধতাও সহ্য করা অসম্ভব! একটা ব্যাং, কি একটা ঝিঁঝি পোকা, কি একটা পাহারাওয়ালার নাক পর্যন্ত ডাকছে না, গাছের পাতায় বাতাসের একটু নিঃশ্বাস পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে না! সারি সারি কোম্পানীর আলোর থামগুলো নীরবে দাঁড়িয়ে জ্বলন্ত চক্ষে যেন থমথমে অন্ধকারকে নিরীক্ষণ করছে। তিমির-তুলির প্রলেপ-মাখানো গাছপালার ফাঁকে ফাঁকে বাড়ীর পর বাড়ী দেখা যাচ্ছে বটে, কিন্তু তারাও যেন প্রেতপুরীর মতন নিস্তব্ধতার ভিতর থেকে একটা ঘুম-ভাঙা খোকার কান্নার আওয়াজ পর্যন্ত জেগে উঠছে না। কে যেন আজ নিদুটির মন্ত্র পড়ে সমস্ত জগৎকে বোবা করে দিয়ে গেছে।
জ্বরের ঘোরে চলেছি তো চলেছিই এই নিঃশব্দ পল্লী ছেড়ে সহরের শব্দের রাজ্যে গিয়ে পড়বার জন্যে প্রাণ যেন আইঢাই করতে লাগল, তবু, এ পথ আর শেষ হতে চায় না। এ পথ যেন আজও শেষ হবে না, কালও শেষ হবে না আমাকে যেন কোন অভিশপ্ত আত্মার মতন চলতে হবে অনন্ত কাল ধ'রে! এক বেচারা ইহুদীর গল্প পড়েছিলুম। কার শাপে তাকে নাকি অনন্তকাল ধরে সারা বিশ্বে ছুটোছুটি করে বেড়াতে হয়েছিল। আমারও তাই হ’ল নাকি?
মাথাটা একবার নাড়া দিয়ে ভাবলুম দুর ছাই! এ-সব কি উদ্ভট কথা ভাবছি? জ্বরে আমার মাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?
মাঝে মাঝে এক-একটা মাঠ যেন এক-একটা অন্ধকারের মায়া-সরোবর। সেখান দিয়ে যেন অন্ধকারের ঢেউ বইছে, অন্ধকারের স্রোত ছুটে আসছে আমাকে গ্রাস করবার জন্যে! অন্ধকারের তরঙ্গের ভিতরে গাছগুলোকে দেখাচ্ছে যেন বড় বড় দৈত্য-দানবের মতো। পথিকের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে খাবার জন্যে তারা ওৎ পেতে প্রস্তুত হয়ে আছে। কান্না-ভরা কনকনে বাতাস এসে চুপিচুপি যেন আমার কানে কানে বলে যাচ্ছে ওহে নিঝুম রাতের অজানা মানুষ! এ মৃত্যুপুরীর ভিতর দিয়ে কোথায় চলেছ তুমি? আমার কথা শোনো, ভূত-প্রেতরা একে একে জেগে উঠছে, এই বেলা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যাও, পালিয়ে যাও, যাও গো!...।
আরো খানিক অগ্রসর হয়ে মনে হ’ল, পৃথিবীর সমস্ত শব্দ এসে আমার দুই পায়ের দুই জুতোর ভিতর আশ্রয় নিয়েছে। প্রত্যেকবার পা ফেলি, আর সেই শব্দগুলো জুতোর ভিতর থেকে চমকে ওঠে, রাজপথের উপরে আছাড় খেয়ে পড়ে আমাকে চমকে চমকে তোলে! শব্দ শুনতে চাই, নিজের পায়ের শব্দ পাচ্ছি। কিন্তু কেন জানি না, সে শব্দ শুনে শুনে মন আমার খুশি হবে কি, আরো বেশী নেতিয়ে পড়তে লাগল! সে যেন রাজপথে ঘুমন্ত কোন অশরীরী প্রেতাত্মার চীৎকার, আমার পদাঘাতে সে যন্ত্রণায় গজরে উঠছে!

আঃ! এতক্ষণ পরে বসা রোডের মোড়ে এসে পড়লুম। অস্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ট্রামওয়ের একটা লোহার থামে ঠ্যাসান দিয়ে দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিলুম।
এখানটাও তেমনি নির্জন ও তেমনি নিস্তব্ধ হলেও আমার মন যেন অনেকটা আরাম পেলে! এই তো ট্রামের রাস্তা, এই পথ ধরে সিধে গেলেই—যত মাইল দূরেই থাক আমাদের পাড়া বাগবাজার পাওয়া যাবেই যাবে! খানিক দূর এগুতে পারলেই লোকজনেরও সাড়া পাব নিশ্চয়, আর ট্রাম ও বাস বন্ধ হলেও ট্যাক্সি মেলাও তো অসম্ভব নয়!
তখন জ্বরে আমার চোখ ছল-ছল, করছে, কান করছে ভোঁ-ভোঁ, আর মাথা ঘুরছে বোঁ-বোঁ করে! বার বার ইচ্ছে হতে লাগল পথের উপরে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়বার জন্যে। কেবল বাপ-মায়ের বিষণ্ণ মুখের কথা ভেবেই মনের সে ইচ্ছা দমন করলাম, অনেক কষ্টে। নিজে-নিজেই বললাম, মন, তুমি শান্ত হও! এই পথের শেষেই আছে তোমার বাড়ী, তোমার আত্মীয়-স্বজন, তোমার নরম তুলতুলে বিছানা! কোন রকমে চক্ষু, মুদে এই পথটুকু পার হতে পারলেই ব্যাস, সকল কষ্ট সকল ভাবনার অবসান!
হঠাৎ দূর থেকে একটা শব্দ জেগে উঠে চারদিকের নিস্তব্ধতার মুখে যেন ভাষা দিলে। ঘড়ঘড় ঘড়ঘড় করে একটা বাজ-ডাকার মতন শব্দ আমার দিকেই এগিয়ে আসছে। তারপরেই শুনলুম ভেঁপুরে আওয়াজ ভোঁপ–ভোঁপ–ভোঁপ–ভোঁপ!
ট্যাক্সি, না বাস?
আহ্লাদে চাঙ্গা আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
তারপরেই দেখা গেল, নীচে দুটো আর উপরে একটা আলো। তিনটে আলো দেখেই বুঝলুম ট্যাক্সি নয়, বাস আসছে।
তাহলে জ্বরের ধমকে আমি ভুল বুঝেছিলাম, বাস, যখন চলছে তখন রাত খুব বেশী হয়নি! কিন্তু আশ্চর্য, এরই মধ্যে এ-অঞ্চলটা এমন ভয়ানক নিস্তব্ধ হয়ে পড়ে? বাবা, আমার কলকাতার গোলমাল বেঁচে থাক, এ-অঞ্চলে আবার ভদ্রলোক বাস করে?
কিন্তু বাসের আলো অত বেশী জ্বলছে কেন? সামনের সারা পথে সে যেন আগুনের ঢেউ বইয়ে ছটে আসছে! আর এই নিরালা পথে অত জোরে ভেঁপু বাজাবারই বা দরকার কি? এ-অঞ্চলের সন্ধ্যের পরেই ঘুমকাতুরে লোকগুলোর কানে যে তালা ধরে যাবে!
উর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে ধুলোয় ধুলোয় পথ অন্ধকার করে একখানা রাঙা টকটকে মস্ত-বড় বাস, আমার কাছে এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল এবং সঙ্গে সঙ্গে একজন তীব্র, তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “ধৰ্ম্মতলা, ওয়েলেসলি, শ্যামবাজার!”
আমি তাড়াতাড়ি বাসে উঠে একখানা গদীমোড়া আসনের উপর গিয়ে ধপ করে বসে পড়লাম। হোক শ্যামবাজারের বাস, এই স্তব্ধ মড়ার মুল্লুক থেকে এখন তো স’রে পড়ি! শ্যামবাজার থেকে বাগবাজার পায়ে হেটে যেতে এমন বিশেষ দেরি লাগবে না।

কিন্তু কেন জানি না, বাসের ভিতরে ঢুকেই আমার বোধ হ'ল, আমি যেন এক জগৎ ছেড়ে আর এক অচেনা জগতের ভিতরে প্রবেশ করলাম!
বাস, ছুটছে, তার ভেঁপু, বাজছে। এত বেগে বাস ছুটছে, তার জানলাগুলো সব খোলা রয়েছে, অথচ বাহির থেকে বাতাসের একটুখানি ঝলক পর্যন্ত আমার গায়ে লাগছে না! ভারি অবাক হয়ে গেলুম। আমার জ্বর কি এত বেশী উঠেছে যে, দেহের অনুভব করবার ক্ষমতাটুকুও আর নেই?
পথ তেমনি নির্জন আর নিঃসাড়। কিন্তু বাতাসও কি আজ ঘুমিয়ে পড়েছে? আমার খালি মনে হতে লাগল, দম বন্ধ হয়ে সারা পৃথিবী আজ মারা পড়েছে তার কোথাও আর জীবনের লক্ষণ নাই। বেচে আছি খালি আমি, এই বাসের ড্রাইভার আর কনডাক্টর।
আমরা তিনজন ছাড়া বাসের ভিতরেও কোন আরোহী ছিল না। থাকবেই বা কেন? এত রাতে কার ঘাড়ে ভূত চাপবে যে, বাসে চড়ে বেড়াতে বেরবে!
বাসে ভেঁপু, বাজছে, আর বাজছে, আর বাজছে! কান যে ঝালাপালা হয়ে গেল! কনডাক্টরের দিকে ফিরে বিরক্ত স্বরে বললুম “ড্রাইভারকে বারণ করে দাও। পথে লোকও নেই, গাড়িও নেই, তবু এত হর্ন বাজছে কেন?”
লোকটা শিখ। মন্ত-বড় লম্বা দেহ, মস্ত বড় দাড়ি। সে কালা আর বোবার মত আমার পানে তাকিয়ে রইল।
আবার বললুম “শুনচ? হর্ন দিতে বারণ কর।”
সে তবু, জবাব দিলে না। ড্রাইভারকে হর্ন থামাতেও বললে না। লোকটা সত্যি-সত্যিই কালা ও বোবা নাকি? কিন্তু না, তাই বা হবে কি করে? এই খানিক আগেই তো সে “ধৰ্ম্মতলা, ওয়েলেসলি, শ্যামবাজার” ব'লে চেঁচিয়ে পাড়া মাত করছিল!
সে বোধ হয়, আমার কথার জবাব দিতে চায় না। এরা কি ভেবেছে, এদের ভেঁপুর আওয়াজে সারা সহরের ঘুম ভেঙে যাবে, আর তাহলেই সবাই বিছানা থেকে লাফিয়ে পড়ে এসে বাসের প্যাসেঞ্জার হয়ে বসবে?
কিন্তু সহর জাগবার কোন লক্ষণ প্রকাশ করলে না। পথের আশেপাশে নেড়ী কুকুরগুলো আরাম করে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে ঘুমোচ্ছিল, কিন্তু এই বাসের সাড়া পেয়েই তারা তাড়াতাড়ি উঠে, ল্যাজ পেটের তলায় ঢুকিয়ে ছুটে পালাতে লাগল ভয়ে কেঁউ কেঁউ করে কাঁদতে কাঁদতে! আজকে বাইরের জীবের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে কেবল ঐ কুকুরগুলোর কাছ থেকে, কিন্তু তারাও দেখা দিয়েই অদৃশ্য হচ্ছে!
কুকুরগুলো কেন আমাদের বাস দেখে পালাচ্ছে? মনের ভিতরে কেবল এই প্রশ্নই জাগতে লাগল কেন? কেন? কেন?
কনডাক্টর কেন আমার কথার জবাব দিচ্ছে না?—কেন? কেন? কেন? ড্রাইভার কেন ক্রমাগত ভেঁপু বাজাচ্ছে? কেন? কেন? কেন?

কনডাক্টারের দিকে ফিরে বললুম, “তোমার ভাড়ার পয়সা নাও।”
সে মস্ত একখানা কালো হাত বাড়ালে। ভাড়া দিয়ে টিকিট নেবার সময় আমার হাতে তার হাতের ছোঁয়া লাগল উঃ, অমনি মনে হল কে যেন একখানা তীক্ষ্ণ বরফের ছুরি দিয়ে আমার হাতে খ্যাঁচ করে খোঁচা মারলে। জ্যান্ত মানুষের হাত এমন ঠাণ্ডা কনকনে হয়!
আশ্চর্য হয়ে তার মুখের দিকে তাকালুম! তার লম্বা চুল আর দাড়ি-গোঁফের জঙ্গলে ভরা মুখখানা বাসি-মড়ার মুখের মত স্থির। তার চোখেও পলক পড়ছে । তার চোখ যেন পাথরে গড়া!
আমার বুকটা গুড়গুড় করতে লাগল। আজকের সহরের এই নির্জনতা, পৃথিবীর এই নিঃশব্দতা, বাতাসের এই অভাব, ভাড়াটে বাসের এই ভেঁপুর আওয়াজ, কনডাক্টারের এই উদাসীন মুর্তি সমস্তই যেন রহস্যময়, সমস্তই যেন অস্বাভাবিক। কী কুক্ষণেই আজ বাড়ীর বাইরে পা দিয়েছি!
যতবার ফিরে তাকাই, ততবারই কনডাক্টারের সেই মড়ার মত স্থির মুখ আর পলক-হারা পাথরে দৃষ্টি চোখে পড়ে! কেমন একটা অমানুষিক ভাবে আমার মনটা ছেয়ে গেল আর সহ্য করতে পারলুম না। সামনের বেঞ্চের উপরে, দুই হাতের ভিতরে মাথা রেখে চোখ মুদে আমি চুপ করে বসে রইলুম। ভাবলাম, শ্যামবাজারে পৌঁছবার আগে আর মাথা তুলে চাইব না! কিন্তু মাথা তুলতে হ'ল আবার চোখ খুলতেও হল।
আধ ঘণ্টার বেশী সময় কেটে গেছে, গাড়ীও না থেমে ক্রমাগত ছুটছে, তবু এখনও শ্যামবাজার এল না কেন?
মুখ তুলে জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে আমার আর বিস্ময়ের সীমা রইল না। শ্যামবাজার তো অনেক দূরের কথা, গাড়ী এখনো ভবানীপুরেই আসে নি! অথচ গাড়ী এত বেগে ছুটছে যে, পথের দু-পাশের বাড়ীগুলো তীরের মতন পিছনে স'রে সরে যাচ্ছে! এও কি সম্ভব?
হতভম্বর মতন মুখ ফিরিয়েই দেখি, গাড়ীর ভিতরে দশ-বারোজন লোক ব'সে রয়েছে! নিজের চোখকেও আমি বিশ্বাস করতে পারলুম না!
আমি হলপ করে বলতে পারি, এতক্ষণের ভিতরে গাড়ী একবারও থামে নি, তবু কোত্থেকে এরা এল, কখন এরা গাড়ীতে উঠল?
একে একে সকলের মুখের পানেই তাকিয়ে দেখলুম, সব মখই মড়ার মতন স্থির, নির্বিকার! সব চোখের পাথুরে দৃষ্টিই আড়ষ্ট হয়ে আছে। কে যেন শ্মশান থেকে কয়েকটা মৃতদেহ তুলে নিয়ে এসে বেঞ্চের উপর সারি সারি বসিয়ে দিয়ে গেছে!
তাদের ভিতরে বাঙালী আছে, বিহারি আছে, সায়েব আছে। কিন্তু তারা সবাই চেয়ে আছে আমার দিকেই। সে চাউনিতে কোন ভাবের আমেজ নেই, সে-চাউনি যেন চাউনিই নয়—অথচ সে চাউনি দেখলেই গা ছমছম করে, দেহের রক্ত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। তাদের চাউনি যেন চোখের ভিতর দিয়ে আসছে না, আসছে আলোকের উপর ওপার থেকে, অন্ধকারের আত্মার ভিতর থেকে, যে-দেশে জ্যান্ত মানুষ নেই, সেই দেশ থেকে! ভাবলেশহীন অথচ ভয়ানক তাদের সেই চাউনি!
আর এক আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, গাড়ীর ঝাঁকুনিতেও তাদের কারো দেহ একটুকুও নড়ছে না! গাড়ীর ভিতরে বসেও তাদের দেহ যেন গাড়ীকে না ছুঁয়ে শূন্যে বিরাজ করছে। মনে হতে লাগল, আমার অজ্ঞাতসারে যেমন হঠাৎ তারা গাড়ীর ভিতরে উড়ে এসে জুড়ে বসেছে, তেমনি হঠাৎ তারা আবার হাওয়া হয়ে হাওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে যেতে পারে, আমার অজান্তেই! যেন তারা ছায়ার কায়াহীন অনুচর দেখা দেয়, ধরা দেয় না। তাদের দেখা যায়, ধরা যায় না।
আমার সভয় দৃষ্টি আবার পথের দিকে ফিরিয়ে নিলাম। গাড়ী তেমনি হেঁচকি-তোলা আওয়াজের মতন ভেঁপুর শব্দ করতে করতে তীরবেগে ছুটছে কিন্তু তখনো ভবানীপুরে আসে নি। আমি শ্যামবাজার, না সোজা যমালয়ের দিকে চলেছি?
কি এক দুঃসহ, অজানা টানে অস্থির হয়ে চোখ আবার গাড়ীর ভিতরে ফেরালুম! গাড়ীতে ইতিমধ্যে লোকের সংখ্যা আরো বেড়ে উঠেছে—তারাও স্থিরনেত্রে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে!
সমস্ত গাড়ীর ভিতরে একটা বোটকা গন্ধ ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে যেন বাসি মড়ার গন্ধ! হাসপাতালের মড়ার ঘরে গিয়ে আমি একবার এই রকম গন্ধই পেয়েছিলুম!
আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিলে, বুকের কাছটা শিউরে শিউরে উঠতে লাগল। আমি কি জেগে আছি, না স্বপ্ন দেখছি?
আর থাকতে না পেরে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললাম, “এই কনডাক্টর, গাড়ী বাঁধো!”
কনডাক্টর কোন সাড়া দিলে না, গাড়ী থামাবারও চেষ্টা করলে না।। আবার বললাম, কিন্তু কোন ফল হ'ল না।
রেগে দাঁড়িয়ে উঠে কনডাক্টারের দেহ ধরে আমি নাড়া দিতে গেলুম কিন্তু তাকে ছুঁতেও পারলুম না। চোখের সামনে তাকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারছি না সে-দেহ যেন হাওয়া দিয়ে তৈরি!
হঠাৎ গাড়ীর সব লোক একসঙ্গে অট্টহাস্য শুরু করে দিলে! সে অদ্ভুত বীভৎস হাসি আসছে যেন অনেক দূর থেকে, অনেক আকাশ-বাতাস ভেদ ক'রে, অনেক সমুদ্র-প্রান্তর পার হয়ে, অনেক নরকের অন্ধকারে ডুব দিয়ে অথচ তার আওয়াজ এত স্পষ্ট যে, আমার কান যেন ফেটে যাবার মত হ’ল!
আমি পাগলের মত চীৎকার করে বললুম, “গাড়ী থামাও, জলদি গাড়ী থামাও এই ড্রাইভার!'
গাড়ী থামানো ঘণ্টার দড়ি ধ'রে আমি ঘন ঘন নাড়তে লাগলুম!
ড্রাইভার এতক্ষণ পরে আমার দিকে মুখ ফেরাল। সে-মুখে এক তিলও মাংস নেই, সে-মুখ সাদা ধবধবে হাড়ের! মুখ-নাক-চোখের জায়গায় তিন-তিনটে গর্ত, দু-ঠোঁটের জায়গায় দু’সারি দাঁত বেরিয়ে আছে।
এতক্ষণ তবে এই পোশাক-পরা কঙ্কালটাই গাড়ী চালিয়ে আসছে? গাড়ীর ভিতরে অট্টহাসির আওয়াজ আরো বেড়ে উঠল।
আর সইতে পারলুম না। সেই ভীষণ অট্টহাসি শুনতে শুনতে আমি একেবারে অজ্ঞান হয়ে গেলুম।
জ্ঞান হ'লে দেখলুম, নিজের ঘরের বিছানায় শুয়ে আছি। আমার চারপাশে বসে মা, বাবা, ভাই-বোনেরা।
শুনলুম, আমি নাকি রসা রোডের ফুটপাথের উপরে জ্বরের ঘোরে বেহুঁশ হ'য়ে শুয়েছিলাম।
কালকের রাতের বিভীষিকার কথা সকলকে বললাম।
বাবা বললেন, “ও-সব বাজে কথা। জ্বরের ঝোঁকে লেকের ধার থেকে রসা রোড পর্যন্ত এসেই তুমি বেহুঁশ হয়ে পড়েছিলে। তারপর ঐ-সব খেয়াল দেখেছ।”
কিন্তু আমার মন বলতে লাগল না, না, আমি যা দেখেছি, তা খেয়াল নয়!
আপলোড: ১৩/৭/২০১৯

No comments:

Post a Comment