Tuesday 1 January 2019

অলৌকিক গল্প (মোবাইল ভার্শন): ইচ্ছামৃত্যুর খোঁজে (শিশির বিশ্বাস)


ইচ্ছামৃত্যুর খোঁজে
শিশির বিশ্বাস
গোড়ায় চিনতে পারিনিঅথচ কলেজে অনুতোষ ছিল সবচেয়ে কাছের বন্ধু। থাকতাম হোস্টেলের একই রুমে। তারপর আমি চাকরি নিয়ে মুম্বাই। অনুতোষের চাকরিতে তেমন উৎসাহ ছিল না। বাড়ির অবস্থা ভালোতা ছাড়া ক্লাসের পড়ার থেকেও ওর বেশি উৎসাহ ছিল তন্ত্রশাস্ত্রে। বেশিরভাগ সময় তাই নিয়ে কাটাত। মাঝেমধ্যেই চলে যেত তারাপীঠ বা অন্য কোথাও। ফিরে আসত দিন কয়েক পরে। উশকোখুশকো চুল। ময়লা জামাকাপড়। কখনও ওই অবস্থায় ঢুকে পড়ত ক্লাসেও। আমরা অবশ্য মেনে নিয়েছিলাম ব্যাপারটা। এমনকী স্যারেরা পর্যন্ত।
কারণও ছিল। একবার এল.পি অর্থাৎ লক্ষ্মীপ্রসন্ন ভট্টাচার্যের ক্লাসে এক ব্যাপার হয়েছিল। ভয়ানক কড়া মানুষ। দরজা বন্ধ করে ক্লাস নিচ্ছেন হঠাৎ দরজা ঠেলার আওয়াজ। ডিস্টারবেন্স এড়ানোর জন্যে এল.পি. বরাবর দরজা বন্ধ করে ক্লাস নেন ভিতর থেকে ছিটকিনি দেওয়া থাকে। বিরক্ত হয়ে পড়া থামিয়ে নিজেই দরজা খুলে দিলেন। বাইরে উশকোখুশকো অবস্থায় দাঁড়িয়ে অনুতোষ। বোঝা যায় ট্রেন থেকে নেমে সোজা চলে এসেছে।
এল.পি.–কে দেখে থতমত খেয়ে গিয়েছিল সেও। কারণ এই ক্লাসটা তাঁর নয়। অন্য একজনের। তিনি আজ না আসায় এল.পি. আগেই চলে এসেছেন। এল.পি. ক্লাস নিচ্ছেন জানলে অনুতোষ কখনওই এই ঝুঁকি নিত নাতাই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়েছিল। ততক্ষণে এল.পি.র বাঁধ না মানা গর্জন শুরু হয়ে গেছে। প্রায় মিনিটখানেক পরে থামলেন তিনি। রাগে থমথম করেছে মুখ। পকেট থেকে রুমাল বের করে মুখের ঘাম মুছছেন অনুতোষ বললস্যার আপনার এখনই বাড়িতে যাওয়া দরকার।
শাট আপ!এল.পি, প্রায় হুঙ্কার ছেড়ে উঠলেনআবার রসিকতা!
না স্যার।শান্ত গলা অনুতোষেরআপনার ছেলে বড় একটা অ্যাকসিডেন্ট করেছে। ঘুড়ি ওড়াতে গিয়ে পড়ে গেছে ছাদ থেকে। বাড়িতে তেমন কেউ নেই। তাই বলছিলাম।
ত্তুমি কী করে জানলে?’
আপনাকে দেখে স্যার। ছেলের নাম কী অক্ষর দিয়ে?’
হ্যাঁহ্যাঁ রঞ্জন।রুদ্ধশ্বাসে এল.পি. বললেন।
স্যার আপনি দেরি করবেন না আর।
তখন মোবাইল ফোন ছিল না। এমন কী টেলিফোনও ছিল মহার্ঘ বস্তু। এল.পি. এরপর দেরি করেননি। বাড়ি বেশি দূরে নয়। ট্যাক্সি ধরে ছুটেছিলেন। আমরা পরে ঘড়ি মিলিয়ে দেখেছি যে সময় অনুতোষ ব্যাপারটি জানিয়েছিল তার সামান্য আগেই ঘটেছিল ঘটনাটি। ওনার স্ত্রীও চাকরি করেন। বাড়িতে কাজের জন্য শুধু এক বয়স্ক মহিলা। কী এক কারণে তাড়াতাড়ি ছুটি হয়ে যাওয়ায় ছেলে স্কুল থেকে ফিরে ছাদে উঠেছিল ঘুড়ি ওড়াতে। তারপরেই বিপত্তি। এল.পি. যখন বাড়ি পৌঁছোন পাড়ার দুটি ছেলে সবে ট্যাক্সি ডেকে এনেছে। উনি সময়মতো পৌঁছোতে পারায় চিকিৎসার ত্রুটি হয়নি।
শুধু এই ঘটনাই নয়। আমরা যারা অনুতোষের খুব কাছের বন্ধু ছিলাম তারা এমন নজির আরো পেয়েছি। জিজ্ঞাসা করলে অনুতোষ অবশ্য বরাবরই পাশ কাটিয়ে গেছে। তাই আমরা ভেবেই রেখেছিলাম পড়া শেষ করে ওকে চাকরির দরজায় ঘুরতে হবে না। তন্ত্র বা জ্যোতিষ চর্চা করে ভালোই রোজগার করতে পারবে। তা ছাড়া নর্থ বেঙ্গলের ওদিকে বাড়ির অবস্থাও ভাল। প্রচুর জমিজমা। পৈতৃক ব্যবসা।
আমাদের অনুমান অবশ্য সম্পূর্ণ মেলেনিচাকরি নিয়ে বাংলা ছাড়লেও গোড়ায় বন্ধুদের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ ছিল। অনুতোষের খবরও পেতাম। কলেজ থেকে বেরিয়ে ও আর বাড়িতে যায়নি। কলকাতায় থেকে গেছেতেমন কোনও তান্ত্রিক বা তন্ত্র চর্চার নতুন কোনও আখড়ার খোঁজ পেলেই ছুটে যায়। সিকিম ভুটান অরুণাচলের কিছু গুম্ফাতেও বেশ কিছুদিন কাটিয়েছে। এমনও শুনেছিলাম ওর ইচ্ছে আছে তিব্বতে যাওয়ার। তন্ত্রের সবচেয়ে গূঢ় তত্বের চর্চা নাকি ওখানেই হয়।
তো এভাবেই চলছিল। কিন্তু তারপরে কেঁদুলির মেলায় হঠাৎ এক মহিলার সঙ্গে পরিচয় হতে অনুতোষ তাকে ভৈরবী অর্থাৎ সাধনসঙ্গিনী করে ঘরে নিয়ে আসার পরেই ছন্দপতন ঘটে যায়ব্যাপারটা ওদের বাড়ির কেউই মেনে নেয়নি। বাড়ির সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ হতে সেখান থেকে টাকাপয়সা আসাও বন্ধ হয়ে যায়। নিরুদ্দেশ হয়ে যায় অনুতোষও। ওর সঙ্গে যোগাযোগও বন্ধ হয়ে যায় তারপর।
সেই অনুতোষের সঙ্গে এতদিন পরে এভাবে দেখা হবে ভাবতেও পারিনি। ইতিমধ্যে আসানসোল বদলি হয়ে এসেছি। অফিসের কাজে গিয়েছিলাম বরাকরের দিকে। কাজ শেষে ফিরছিড্রাইভার রামেশ্বর বললস্যার এদিকে ভূবনডাঙা শ্মশানে অল্পদিন হল অনুতোষবাবা নামে এক ক্ষ্যাপা সাধু এসেছেন। সঙ্গে ভৈরবী। মড়া পোড়ানোর কাজ করেন। তবে টাকাপয়সা কিছু নেন না। অল্প দিনের মধ্যেই অনেক কথা ছড়িয়েছে ওনাকে নিয়ে। যাবেন নাকি?
তখন শেষ বিকেল। সারাদিন কাজের চাপে ঠিকমতো পেটেও কিছু পড়েনি। ঘরে ঢুকতে পারলে কিছু বিশ্রাম পাওয়া যায়। কিন্তু হঠাৎ সাধুবাবার নাম আর ভৈরবীর কথায় প্রায় চমকে উঠলাম। তবে সরাসরি উত্তর না দিয়ে বললামখুব বড় সাধুবাবা নাকি?’
আসলে রামেশ্বরের ইচ্ছেও যে যথেষ্ট সেটা ততক্ষণে টের পেয়ে গেছি। আমার কথায় রামেশ্বর ঢোঁক গিলে বললজানি না স্যার। ওনাকে দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই। শ্মশানে মড়া পোড়ানোর কাজ করেন। অথচ টাকাপয়সা নেন না। কী করে যে ওনাদের পেট চলে সেটাও এক রহস্য। নানা কথা শোনা যায়। আর
বলতে–বলতে রামেশ্বর হঠাৎই থেমে গেল।
কৌতূহলে বললামকী? থামলে কেন?’?
আপনি লেখাপড়া জানা মানুষতাই বলতে সংকোচ হয়। অনেকে বলে উনি নাকি শ্মশানের ভূত–প্রেতদের বশ করেছেনসন্ধের পরে তাদের নিয়ে থাকেন। আগে ওই শ্মশানে মানুষ রাতেও মড়া নিয়ে যেত। ভয়ে এখন আর যায় না।  
লোকালয় থেকে অনেকটা দূরে নদীর ধারে শ্মশান। এই শেষ বিকেলে ভয়ানক নির্জন। শুধু বাতাসের শোঁশোঁ শব্দ। শ্মশানের এক কোনে জীর্ণ এক চালাঘর। রামেশ্বরই জানাল সাধুবাবার আস্তানা। অদূরে জনাকয়েক শবযাত্রী। কাছেই এক মহিলা চিতার কাঠ সাজাচ্ছেন। রামেশ্বর সেদিকে তাকিয়ে বললস্যার উনিই সেই সাধুবাবার ভৈরবী। শুনেছি বাইরে বেশি আসেন না। দেখাও যায় না তেমন। আজই অন্যরকম দেখছি।
রামেশ্বর যে এখানের অনেক খবর রাখে বুঝতে পারছিলাম। ওকে দুএকটা কথা জিজ্ঞাসা করাই যেত। কিন্তু ততক্ষণে গাড়ি শ্মশানে পৌঁছে গেছে। রামেশ্বর এক শবযাত্রীকে প্রশ্ন করে জানতে পারল অনুতোষবাবাই চিতা সাজাচ্ছিলেন। হঠাৎই কাজ ফেলে চলে গেছেন। পরিবর্তে ভৈরবী এসে কাজে লেগেছেন।
মহিলার পরনে লালপেড়ে শাড়ি। কপাল আর সিঁথিতে অনেকটা মেটে সিঁদুর। হাতে দু’গাছি শাঁখা। শ্যামলা দোহারা মাঝবয়েসী মহিলাটি ওই বয়সের আর পাঁচজনের থেকে কোথায় যেন আলাদা। মুখের ভাবে কোনও অভিব্যক্তি নেই। কেমন পুতুলের মতো। চোখে শূণ্য দৃষ্টি।
কীভাবে কথা শুরু যায় ভাবতে–ভাবতে সামান্য এগিয়েছি উনি মাথার কাপড় টেনে দিলেনসামান্য গলা ঝেড়ে নিয়ে বললামঅনুতোষবাবার সঙ্গে একবার দেখা করার ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম।
উত্তরে উনি বললেনগোঁসাই ঘরে শুইয়া আছেন। কেমন যেন ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর মহিলার।
আমি একবার দেখা করেই চলে যেতাম। আসলে
জানি।হাত তুলে আমাকে থামিয়ে মহিলা আগের মতোই ঘড়ঘড়ে গলায় বললেনআপনে একটু দেরি করেন বরং। দেখি উনি রাজি হন কিনা।
শব ইতিমধ্যে চিতায় তোলা হয়েছে। দ্রুত বাকি কাজ শেষ করে মহিলা আমাকে অনুসরণ করতে বলে পায়ে পায়ে এগিয়ে গেলেন অদূরে পর্ণকুটিরের দিকে। মাটির দেওয়ালের ছোট একটা ঘর। সামনে এক চিলতে খোলা বারান্দা। গ্রামের শ্মশানে এমন ঘর সাধারণত থাকে নাশবযাত্রীদের বিশ্রামের জন্য থাকে বড়জোর একটা খোলা চালা। পরে শুনেছি এই শ্মশানে তাও ছিল না। অনুতোষবাবা এখানে ঠাঁই নেওয়ার পর নিজেরাই ঘর তুলে নিয়েছেন।
গ্রামের শ্মশান। শবদেহ সপ্তাহে দু–একটির বেশি আসে না। কিন্তু লোক চলাচলের পথ খুব দূরে নয়। তবু এই ঘর কবে তৈরি হল কেউ বলতে পারে না। এবং তা নিয়ে রয়েছে নানা গুজব।
সে যাই হোক আমাকে বারান্দায় অপেক্ষা করতে বলে মহিলা ঘরে গেলেন। একটু পরেই ভিতর থেকে তাঁর কণ্ঠস্বর শোনা গেলগোঁসাই শুনছেন উনি আপনার সাথে কথা কইতে চান। দাঁড়াইয়া আছেন।
এভাবে বার দুই বলার পরে ভিতরে চাপা খড়মড় আওয়াজ। একটু পরেই ভিতর থেকে যে মানুষটি বের হয়ে এল তাঁকে দেখে গোড়ায় চিনতে না পারলেও খানিক লক্ষ করতে বুঝলাম অনুমানে ভুল নেই। সামনের মানুষটি অনুতোষই বটে। দুজনের শেষ দেখা প্রায় পঁচিশ বছর আগে। সেই উন্নত ললাট। চিবুকের নীচে ছোট এক জড়ুল। শরীর অবশ্য আগের মতো নেই। অনেক কৃশতবে তুলনায় বয়েসের ছাপ তেমন পড়েনি। কপালে বড় সিঁদুরের ফোঁটা। পরনে সাদা ধুতি। খালি গা।
হাঁ করে খানিক তাকিয়ে থেকে কথা বলতে যাবঅনুতোষ নিস্পৃহ দৃষ্টিতে আমার ওপর সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললআজ নয় রে সোমেন। তুই তো আসানসোলে আছিসঅন্য একদিন আয় না। গল্প করা যাবে। অনেক কথা আছে। তবে একলা আসিস। বাসে ভূবনডাঙা শ্মশানের কথা বললেই নামিয়ে দেবে।
অনুতোষের সেই কথায় বুঝতে অসুবিধে হয়নি বহুদিন পরে দেখা হলেও আমার অনেক কিছুই ওর জানা। কে জানে আজ দেখা করার ইচ্ছে নেই বলেই হয়তো কাজ ফেলে ওর ঘরে চলে এসেছে। অগত্যা সম্মতি জানিয়ে বিদায় নিয়েছিলাম।
সামান্য হলেও ব্যাপারটা চাপা থাকেনি। পূর্ত দপ্তরে চাকরির সুবাদে অনেকেই আমাকে চেনে। সেদিন শ্মশানে উপস্থিত তেমন কেউ হয়তো ছিলেন। আর রামেশ্বর তো অবশ্যই। অফিসের অনেকেই দেখলাম জেনে ফেলেছে ব্যাপারটা। রামেশ্বর একদিন কাঁচুমাচু মুখে বলেই ফেললস্যার সাধুবাবার কাছ থেকে আমার মেয়ের জন্যে একটা তাবিজ এনে দিন না।
রামেশ্বরের মেয়ে পোলিওয় প্রায় পঙ্গু। বললামসে তো তুমিও চাইতে পারো। আমাকে দেবে কেন?’
আপনি বললে দেবে স্যার।
কেন?’
যেভাবে ভৈরবী সেদিন আগ্রহ নিয়ে আপনার সঙ্গে কথা বললেন। সঙ্গে করে ঘর পর্যন্ত নিয়ে গেলেন। এমনকী অনুতোষবাবা পর্যন্ত বাইরে এসে কথা কইলেন তাতেই বুঝেছি। ওনারা কখনই এমন করেন না। কারও সঙ্গে বিশেষ কথাও বলেন না। গোড়ার দিকে অনেকেই ফলমূল ভেট নিয়ে যেতেন। কিন্তু স্পর্শও করেননি কেউ। ফিরিয়ে দিয়েছেন। কেউ ওনাদের কখনও কিছু খেতেও দেখেনি। এখন তো ওই ঘরের কাছে পর্যন্ত যায় না কেউ। শোনা যায় ওই ঘরের ভিতর নাকি ভুতপ্রেতেরও বাস। অসীম ক্ষমতা ওনাদের।
রামেশ্বরের সেই মুখের দিকে তাকিয়ে বললামসবই তো অনুমান। তেমন প্রমাণ কিছু পেয়েছ?’
সে গোড়ার দিকে একবার হয়েছিল স্যার। কাছেই গ্রামের এক বউ ভেট দেওয়ার জন্যে ডালায় কিছু ফলমূলের সঙ্গে একটা পানও এনেছিলঅনুতোষবাবা এমনিতে এসব ছুঁয়েও দেখেন না—ফিরিয়ে দেন। সেদিন কিন্তু ডালার পানটা হাতে নিয়ে অনেকক্ষণ দেখলেন। তারপর ফিরিয়ে দিয়ে বললেন এই পান পাতায় কোনও খুঁত নেই মা। তোর সংসারেও কোন খুঁত তো থাকার কথা নয়। পানটা যত্ন করে ঘরে রেখে দিস।
বিধবা মহিলার একমাত্র ছেলে তখন বেজায় অসুস্থ। এরপর ধীরে–ধীরে সে সুস্থ হয়ে ওঠে। অনেকেই বলবে চিকিৎসার কারণে। কিন্তু সেই পান শুকিয়ে গেলেও তার সবুজ রং এখনো আগের মতোই। সামান্যমাত্র কুঁচকে যায়নি। এই ঘটনা রাষ্ট্র হয়ে যাওয়ার পরে অনেকেই এসেছেঅনুতোষবাবা ফিরেও তাকাননিআর–একদিন চলুন না স্যার। আপনি থাকলে ভরসা পাই।
ইচ্ছে থাকলেও রামেশ্বরকে ভরসা দেওয়ার উপায় ছিল না। বরং ওর কথায় এটুকু নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলাম সেদিন আমাকে বলা সাধুবাবার কথা শুনতে পায়নি ওরা। তা হলে ঝামেলা আরও বাড়ত। তাই কথা বাড়াইনি। তবে এরপর কৌতূহল যে বেড়েছিল তা বলাই বাহুল্য।
দিনকয়েক পর এক ছুটির দিনে আবার ধাওয়া করেছিলাম।
বাস থেকে নেমে মিনিট পনেরোর হাঁটা পথ। দুপুরের চড়া রোদ মাথায় নিয়ে যখন যথাস্থানে এসে পৌঁছোলাম দেখি খোলা বারান্দায় অনুতোষ আমার অপেক্ষায় বসে। গায়ে আজ রক্তবস্ত্র। রুদ্রাক্ষের মালা।
আমাকে আগ্রহে পাশে বসিয়ে মেতে উঠল পুরোনো দিনের কথায়। এই অনুতোষ আমার চেনা। তাই ভিতরে কিছু স্বস্তি যে পাচ্ছিলাম তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু শুধু পুরোনো কথা শোনার জন্যে এই গনগনে দুপুরে এখানে ধাওয়া করিনি। প্রসঙ্গ পালটে হঠাৎই বললামএবার তোর কথা বল। তাই শুনতেই এলাম রে। কতদিন পর দেখা।
সেই কথায় কেমন থমকে গেল অনুতোষ। আমার ওপর সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে বললসে সব নাই বা শুনলি ভাই।
অনুতোষ বলল বটে কিন্তু ওর মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম অনেক কথা জমে আছে ওর ভিতরে। কিছু খোলসা করতেই চায়। উসকে দিতে বললামতা ঠিক। তোর তন্ত্র সাধনা নিয়ে কোনও দিনই অতিরিক্ত কৌতূহল প্রকাশ করিনি। তুইও বলিসনিকিন্তু অন্য কথা তো বলতেই পারিস। শুনেছি এখানে অল্পদিন হল এসেছিল। কোথায় ছিলি এতদিন?’
সে কী আর এক জায়গায় রেশুনতে চাইছিস যখন বলেই ফেলি। হয়তো পরে আর সুযোগ হবে না।অল্প থেমে অনুতোষ ফের বলতে শুরু করলতন্ত্রশাস্ত্রের প্রতি আমার ঝোঁক সেই কলেজ জীবন থেকেএই বর্ধমান জেলার এক অখ্যাত শ্মশানে এক তান্ত্রিক সাধুর সঙ্গে সামান্য আলাপের পর। তারপর জানিস তো তারাপীঠেও গেছি বহুবার। রাতের পর রাত তান্ত্রসাধক আচার্যদের সঙ্গে কাটিয়েছি। কিছু জানা গেলেও মন ভরেনি। কলেজ থেকে বেরিয়ে সবাই ঢুকে পড়ল চাকরি বা অন্য কিছুতে। বাড়ি থেকে তেমন চাপ ছিল না। তাই নতুন কিছুর খোঁজে ঘুরে বেড়াই শ্মশান আর নানা আশ্রমে তান্ত্রিক আচার্যদের খোঁজে। ওই সময় সিকিমের এক গুম্ফায় হঠাৎ খোঁজ পেলাম এক পুরোনো পুঁথির। গুম্ফায় যাঁরা ছিলেন তাঁদের কারও সংস্কৃত জানা ছিল না। তাই নিতান্ত হেলাফেলায় পড়ে ছিল তালপাতার পুঁথিটি। সংস্কৃত ভাষায় লেখা মহাবজ্রতন্ত্রম
তন্ত্রের বিভিন্ন শাখার কথা জানা থাকলেও এটি একেবারেই নতুন। আগে শুনিনি। তাই কৌতূহলী হয়ে উঠতে দেরি হয়নি। পুঁথিটি সঙ্গে নিয়ে এসেছিলাম। আমার আগ্রহ দেখে গুম্ফার প্রধান লামা সম্মতি দিতে দ্বিধা করেননি। জানিস তো বিজ্ঞানের ছাত্র হলেও সংস্কৃত ভাষার উপর আমার আগ্রহ বরাবর। চর্চা আগে থেকেই ছিল। কিন্তু পুঁথিটি পাঠের প্রধান অন্তরায় হল সেটি সিদ্ধং লিপিতে লেখা। মূল ব্রাহ্মী থেকে উদ্ভূত এই সিদ্ধং লিপির পূর্বাঞ্চলীয় রূপ থেকেই বাংলা লিপির উদ্ভব। পুঁথিটি সম্ভবত লেখা হয়েছিল একাদশ শতকের পাল আমলে এই বাংলাতেই। অক্ষরগুলি তাই মূল সিদ্ধং লিপি থেকে কিছু ভিন্ন। তাই পাঠ করতে যথেষ্টই বেগ পেতে হল। সময় লাগল। কিন্তু খুলে গেল তন্ত্রের এক অজানা অধ্যায়।
এতদিন চলছিল একরকম। কিন্তু এই পুঁথিই আমার জীবনযাত্রা আমূল বদলে দিয়ে গেলমহাবজ্রতন্ত্রম তন্ত্রশাস্ত্রের এক অতি উচ্চমার্গের সাধনা। ভয়ানক কঠিন। সেই সময় বৌদ্ধ মঠ বা বিহারে মুষ্টিমেয় কয়েকজনই এই সাধনা করার সাহস পেতেন। অন্ধকার কুঠুরির মধ্যে দিনের পর দিন বিভিন্ন তান্ত্রিক ক্রিয়াকলাপ নিয়ে পড়ে থাকতেন তাঁরা। কুঠুরির দরজা বন্ধ হয়ে গেলে বায়ু চলাচলের ছিদ্রপথ ছাড়া বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁদের অন্য কোনও যোগাযোগ থাকত নাখাদ্য তো দূরের কথা জলস্পর্শ করাও ছিল নিষেধকেউ–কেউ সফল হতে পারতেন। প্রাচীন বৌদ্ধ মঠ বা বিহারের ধ্বংসাবশেষের ভিতর এমন অনেক কুঠুরির সন্ধান পাওয়া গেছে। সেগুলি দেখে ভাবাও যায় না তার ভিতর কেউ এক নাগাড়ে বছরের পর বছর পড়ে থাকতে পারে
এই পর্যন্ত বলে অনুতোষ অল্প থামল। হঠাৎ মনে পড়ল রামেশ্বরও বলেছিল অনুতোষবাবা আর তাঁর ভৈরবীকে কেউ খাদ্য এমনকী জলও কখনও খেতে দেখেনি। তখন বিশ্বাস হয়নি। কিন্তু এই মুহূর্তে অনুতোষের মুখের দিকে তাকিয়ে সারা শরীর কেমন ছমছম করে উঠল। হাঁ করে তাকিয়ে রইলাম শুধু।
অনুতোষ আমার সেই মুখের ওপর সামান্য চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল ‘ব্যাপারটা অবশ্যই খুব সহজ ছিল না। মুষ্টিমেয় কয়েকজনই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধিলাভ করে সেই কুঠুরি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতেন। তাঁরা অসীম ক্ষমতাই শুধু নয় ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী হতেন।অনুতোষ অল্প থামল ‘এবার অন্য একটা কথা বলি। ঐতিহাসিকেরা নানা প্রমাণ পেয়েছেন পাল সম্রাটদের আমলে একটা সময় স্থানীয় শাসনভার বিভিন্ন বৌদ্ধ মঠের আচার্যদের উপরেই ন্যস্ত ছিল। অথচ সেই অর্থে তাঁদের কোনও আরক্ষী অর্থাৎ পুলিশ বাহিনী ছিল না। তা হলে কোন শক্তি দিয়ে তাঁরা শাসনের কাজটা চালাতেন?’
‘মানছি’ মাথা নাড়লাম আমি ‘তাঁরা অসীম ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। কিন্তু যে–সাধনার কথা বলছিস তা কি সম্ভব? অনশন করে দু–এক সপ্তাহ কাটানো যায়কেউ–কেউ হয়তো দু–এক মাসও পারেকিন্তু বছরের পর বছর অসম্ভব।
তা নয় রে। ম্লান হাসল অনুতোষ: খাদ্য বলতে আমরা বুঝি শুধুই উদরপূর্তি। কিন্তু বাতাস সেও তো খাদ্য। মহাবজ্রতন্ত্রম অনুসারে বাতাসেও রয়েছে বেঁচে থাকার যাবতীয় উপকরণ। নির্ধারিত মাত্রায় শুধু বাতাস গ্রহণ করেও দেহের খাদ্যের প্রয়োজন মেটানো সম্ভব। বেঁচে থাকাও যায়। মহাবজ্রতন্ত্রমে রয়েছে এমন আরও একটি খাদ্যের কথা স্ত্রীসহবাস। শুধু যৌন নয় শরীরের যাবতীয় অন্য ক্ষুধারও নিবৃত্তি হয় ওতে। আসলে উভয় ক্ষুধাই তো প্রকৃতি নির্দিষ্ট। তাই অনেক ভেবে শেষ পর্যন্ত যখন মনস্থির করে ফেললাম প্রয়োজন হল একজন ভৈরবীর। চন্দ্রাকে তখনই প্রস্তাব দেই। ওর সঙ্গে পরিচয় তখন অল্প দিনের। গোঁড়া বৈষ্ণব পরিবারের মেয়ে চন্দ্রানবদ্বীপে বাড়ি। কেঁদুলির বাউল মেলায় এসেছিল বাবার সঙ্গে। সেখানেই দেখামেয়েটির বিভিন্ন লক্ষণ দেখে বুঝেছিলাম তন্ত্রসাধনায় ভৈরবী হওয়ার জন্যে আদর্শ গোড়ায় ও রাজি হয়নি। ভয়ানক আপত্তি ছিল ওর বাবারও। আমিও জোর করিনিতবে যোগাযোগ ছিলবিভিন্ন মেলায় গান গাইত ওরাআমি প্রায়ই চলে আসতামমেলায় ঘুরতাম ওদের সঙ্গে স্বভাবতই ঘনিষ্ঠতা বাড়ছিল। শেষে চন্দ্রা নিজেই একদিন রাজি হয়ে গেল। ওর বাবার আপত্তি সত্ত্বেও।
‘আপত্তি শুধু চন্দ্রার বাড়ি থেকেই নয় আরও বড়ো বাধা এল আমার নিজের বাব–মার কাছ থেকে। তাতে সুবিধেই হয়েছিল বরং। জায়গা আগেই ঠিক করা ছিল। উত্তরপ্রদেশে নেপাল সীমান্তের কাছে এক সুপ্রাচীন বৌদ্ধ মঠের ধ্বংসাবশেষ আগেই দেখে রেখেছিলাম। একসময় আর্কিয়োলজিক্যাল দপ্তর থেকে কিছু খোঁড়াখুঁড়ি হয়েছিল। তাতেই বের হয়েছিল এমনই কিছু সাধন-কক্ষ। তন্ত্রশাস্ত্রে একই উদ্দেশ্যে পূর্বে ব্যবহার করা এমন স্থান এক কথায় আদর্শঅন্য সুবিধেও ছিল দুর্গম জায়গায় হওয়ার কারণে আর্কিয়োলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট চলে যাওয়ার পরে রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা আর হয়নি। নির্জন অরণ্যের ভিতর জায়গাটি তেমনই পড়ে রয়েছে। চন্দ্রা রাজি হয়ে যেতে আর দেরি করিনি।
এই পর্যন্ত বলে থামল অনুতোষপ্রায় রুদ্ধশ্বাসে প্রশ্ন করলামতারপর?’
তারপর খুব বেশি কিছু আর বলতে পারব না। সেভাবে মনেও নেই। সাধনার অন্তে যেদিন মহাবজ্রতন্ত্রমের পূর্ণ মন্ত্র নিবেদন করে চোখ মেলে চাইলাম গোড়ায় মনে হয়েছিল অল্প সময় আগে কক্ষে সাধনায় বসেছিলাম। কিন্তু পরে বুঝেছি এর মধ্যে অতিক্রান্ত হয়ে গেছে পুরো তিন বছর কয়েক মাস।
ক্কী বলছিস! পুরো তিন বছর ধরে ফাস্টিং! অনশন! এভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব নাকি?অজান্তেই কথাগুলো আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে গেল
তোকে তো আগেই বলেছিমৃদু মাথা ঝাঁকাল অনুতোষ: তথাকথিত ফাস্টিং করেও বেঁচে থাকা সম্ভব যদি অন্য দুটি খাদ্য মজুত থাকে। বাতাস আর কামক্ষুধার পরিতৃপ্তি
বিজ্ঞানের ছাত্র। বেশ জানি অনুতোষের ওই কথার কোনও বিজ্ঞান ভিত্তিক ব্যাখ্যা নেই। তবু মুখে প্রতিবাদের ভাষা জোগাল না।
আমার মনের কথা বুঝে নিতে অনুতোষের বিলম্ব হয়নি। মৃদু হেসে বলল ‘আমিও তো ওই বিজ্ঞানেরই ছাত্র রে। ঠিক কথা আধুনিক জীববিজ্ঞান অনুসারে এমনটা সম্ভব নয়। কিন্তু তন্ত্রশাস্ত্রে ব্যাপারটার ব্যাখ্যা কিছু অন্য রকম। আর তা যে মিথ্যে নয় তার প্রমাণ তো আমি নিজেই। নয় কী?’
অনুতোষের ওই কথায় নিঃশব্দে মাথা নাড়লাম শুধু। অল্প থেমে অনুতোষ ফের মুখ খুললতবে ঘটনা হল ইচ্ছামৃত্যুর খোঁজে ছুটতে গিয়ে শুধু নিজের কথাই চিন্তা করেছিচন্দ্রার কথা একবারও মনে হয়নি। নিতান্ত স্বার্থপরের মতো শুধুই ব্যবহার করেছি ওকে। অথচ ও কিন্তু নিজের জন্য একবারও ভাবেনি। এই পাষণ্ড মানুষটার জন্যে নিজেকে রিক্ত করে দিয়েছে। সেই ভীষণ অন্যায় সেই ভুলের মাশুল
অনুতোষের কথার মাঝেই ঘরের ভিতর থেকে মৃদু খড়মড় শব্দে কিছু নড়ে উঠল। ভেসে এল সেই পুরুষালি ঘড়ঘড়ে কণ্ঠগোঁসাই খালি পুরানা কথা ঘাঁটেন কেন? মানা করছি না।
মানা করলেই কী মন মানে চন্দ্রা! একটা জীবন তো!বলতে–বলতে অনুতোষ আচমকা উঠে দ্রুত ঘরে চলে গেল
সত্যি কথা বলতে কী অনুতোষের সঙ্গে নানা কথায় একেবারেই খেয়াল ছিল না ঘরে ভৈরবী চন্দ্রাও রয়েছে। একবার জিজ্ঞাসাও করা হয়নি ওর কথা। অপ্রস্তুত হয়ে বসে আছি। ধীর পায়ে ভৈরবী ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন। পরনে সেই লালপেড়ে শাড়ি। সিঁথি আর কপালে মেটে সিঁদুর। হাতে দুগাছি শাঁখা। হুবহু আগের দিনের প্রতিমূর্তি যেন। মাথায় কাপড় টেনে দিয়ে সেই ভারী পুরুষালি গলায় বললেনদাদা আপনার বন্ধুর মাথার ঠিক নাই। ওনার কথায় কান দিবেন না।
তাড়াতাড়ি দু–হাত জোড় করে বললামসরি দিদি আপনার কথা একবারও মনে আসেনি। জিজ্ঞাসাও করিনি।
তাতে কী?’ উনি বললেনআমি কী একটা মানুষ? বাপের সাথে মেলায় গান করিয়া বেড়াইতামদাদা একটা কথা কই আপনারে। গোঁসাই এইভাবে শ্মশানমশানে থাকেন। অথচ একসময় কত আদরে ছিলেনদাদা আপনে টাউনে একটা ঘর দেইখা দেন না। কলিকাতায়। মানুষের কিছু ইষ্টও তো হয়। ওনার নখের যুগ্যি না হইয়াও সেইখানে কতজন দিব্যি জমাইয়া নিছেন
তা হয় না চন্দ্রা। হয় না।ঘরের ভিতর থেকে প্রায় আর্তনাদ করে উঠল অনুতোষ।
কেন হইবে না? ইচ্ছামরণের ক্ষমতা পাইয়াও এইভাবে জীবনটা নষ্ট করবেন তা হইবে না। আমি দেব না। দাদা আপনে কান দিবেন না ওনার কথায়। 
আমি কিছু বলার আগেই ভিতর থেকে অনুতোষ বললসোমেন চন্দ্রার কথায় কান দিস না তুই। ওসবের ইচ্ছে এখন আর নেই আমার।
তা কেন রে অনুতোষ।আমি বললামউনি ঠিকই তো বলেছেন। তা ছাড়া তোর কাছেই যা শুনলাম তাতে এভাবে পড়ে থাকা কি ঠিক? কলকাতায় এখনই হয়তো হবে না। তবে আসানসোলে দু–চার দিনের মধ্যেই আমি ঘর দেখছি।
ইতিমধ্যে কখন মহিলা উঠে ঘরে গেছেন বুঝতে পারিনি। ভিতর থেকে তাঁর গলার আওয়াজ পেলামআর আপত্তি করবেন না গোঁসাই। আমার কথাডা শোনেন।
কয়েক সেকেন্ড খড়মড় আওয়াজ ঘরের ভিতর। তারপরেই দরজা দিয়ে বের হয়ে এল অনুতোষ। আমি ওর দিকে তাকিয়ে বললামতা হলে ওই কথাই রইল রে। সব ঠিক করে আগামীকাল বা পরশুর মধ্যে আমি আসব।
ভেবেছিলাম আপত্তি জানাবে। সেসব না করে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইল ওর সেই চোখের দিকে তাকিয়ে এই প্রথম ভিতরে কেমন একটা অস্বস্তি টের পেলাম। মনে হল সামনের মানুষটি যেন এই জগৎয়ের কেউ নয়। অন্য কোনও লোকের। হঠাৎ কেমন শিরশির করে উঠল সারা শরীর। তাড়াতাড়ি বললাম ‘আজ তা হলে চলি রেমনে হয় দু–এক দিনের মধ্যেই খবর আনতে পারব।
দু–একদিনের কথা বলেছিলাম। কিন্তু তার আগেই চমৎকার এক ফ্ল্যাটের খবর আনল রামেশ্বর। এই ব্যাপারে ও সবচেয়ে উপযুক্ত বুঝে দায়িত্বটা ওকেই দিয়েছিলাম। জানতাম নিজের স্বার্থেই চেষ্টার ত্রুটি করবে না। হলও তাই। পরের দিন সকালেই ও খবর আনল শিবমন্দিরের কাছে রাস্তার ওপর দু–কামরার একটা ফ্ল্যাট পাওয়া গেছেব্যস্তসমস্ত জায়গা। অল্পদিনেই অনুতোষ পসার জমিয়ে ফেলতে পারবে। রামেশ্বরের কাছে ভাড়াটের পরিচয় পেয়ে মালিক অ্যাডভান্সও নিতে চায়নি।
খবর নিয়ে দুপুরের আগেই ছুটলাম ভূবনডাঙা শ্মশানের দিকে। আজ আর বাসে নয় রামেশ্বরের গাড়িতেই।
শ্মশানে আজ কোনও মৃতদেহ আসেনি একা অনুতোষ বসে আছে বারান্দায় সম্ভবত আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল বসতে বলল অনুতোষের জন্যে এত তাড়াতাড়ি কিছু ব্যবস্থা করতে পারায় ভিতরে তখন এক অন্য অনুভূতি অযথা সময় নষ্ঠ না করে ছুটে আসা সেই কারণে। হঠাৎ বললামকদিন তোর এখানে এলাম একবার ঘরে নিয়েও তো বসালি না!’
তা হলে ভিতরেই চলনিরাসক্ত গলায় বললেও অনুতোষ উঠে দাঁড়াল
মাটির দেওয়ালের ছোট এক খুপরি ভিতরে ঢুকতে মুহূর্তে একরাশ অন্ধকারের ভিতর ডুবে গেলাম যেন ভেবেছিলাম অল্প সময়ের মধ্যে অন্ধকার সহ্য হয়ে যাবে কিন্তু মিনিট খানেক কেটে যাওয়ার পরেও কিছুমাত্র উন্নতি হল না ভিতরে সেই একই রকম নিশ্ছিদ্র অন্ধকার অনুতোষ ইতিমধ্যে দরজা সামান্য ভেজিয়ে দিয়েছে অবশ্য কিন্তু তাতে এমন হবার কথা নয় দরজার উপরে দেওয়ালে ছোট এক ফোকর সামান্য আলোর চিহ্ন নেই সেখানেও সেদিকে তাকিয়ে মনে হল বাইরে রৌদ্রজ্জ্বল দিন নয় নিস্তব্ধ অমাবস্যার রাত যেন সামান্য শব্দ বা প্রাণের সাড়ামাত্র নেই অথচ নির্জন শ্মশান হলেও একটু আগে বাইরে পাখির ডাক শুনেছি বাতাসের শব্দ সব যেন উধাও হয়ে গেছে মুহূর্তে নিস্তব্ধ অন্ধকারে একা হঠাৎ সারা শরীর কেমন ছমছম করে উঠলেও ব্যাপারটাকে আমল না দিয়ে অনুতোষকে উদ্দেশ করে বললামতোর এই ঘরটাকেও তো সেই সাধনাকক্ষ বানিয়ে রেখেছিস দেখছি! এত অন্ধকার!’
প্রত্যুত্তরে অন্ধকারের ভিতর অনুতোষের অল্প হাসির শব্দ শোনা গেল কোনও কথা বলল না ওই সময় হঠাৎ খেয়াল হল ইতিমধ্যে ঘরে তৃতীয় কোনও ব্যক্তির উপস্থিত টের পাইনি তাড়াতাড়ি বললামভৈরবী নেই?’
আছে তো ঘরেইঅনুতোষের কথা শেষ হতেই কাছে কামারশালায় হাপর টানার মতো আওয়াজে কেউ বড় একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল প্রায় চমকে উঠলাম।
ওই সময় হঠাৎই এক চিলতে আলো দেওয়ালের সেই ফোকর দিয়ে ভিতরে এসে পড়ল। মেঝের একধারে ছোট এক বিছানায় আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে কেউ। তাড়াতাড়ি বললাম ভৈরবী অসুস্থ নাকি? এত বেলায় শুয়ে!’
না রে তেমন কিছু নয়অনুতোষ বললচন্দ্রা আমার বন্ধু সোমেন দেখা করতে এসেছে
চাদর মুড়ি দেওয়া মানুষটা সেই কথায় নড়ে উঠল খড়মড় আওয়াজে উঠে বসল বিছানায়দাদা নাকি? ঘরের কথা কইছিলাম পালেন?’
কিন্তু সে–কথার উত্তর দেবে কে! উঠে বসতে মানুষটার মুখের উপর থেকে কাপড় তখন সরে গেছে একটা শুকনো নরকঙ্কাল! মুখ নেড়ে কথা বলছে চিলতে আলোয় ঝকঝকে দু–সারি দাঁত। আচমকা ওই দৃশ্য দেখে ভিতরের অন্তরাত্মা পর্যন্ত তখন কেঁপে উঠেছে ঘর থেকে মুহূর্তে ছিটকে বের হয়ে ছুটেছি অদূরে গাড়ির দিকে কথা বলায় সামর্থ্যও হারিয়ে ফেলেছি কোনওমতে গাড়িতে উঠে ইশারায় রামেশ্বরকে স্টার্ট দিতে বললাম পিছনে তখনও ভৈরবী চন্দ্রার কণ্ঠস্বর প্রায় হাহাকারের মতোঘর পালেন দাদা? টাউনে গোঁসাইর জন্যে একটা ঘর
কেন ওইভাবে ছুটে এসেছিলাম রামেশ্বরকে বলতে পারিনি। এমনকী আসানসোলে ফিরেওকিন্তু অন্য খবরটা পাওয়া গেল সন্ধের আগেই। রামেশ্বরই খবরটা আনল। হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে জানালশুনেছেন স্যার। ভূবনডাঙা শ্মশানে সাধুবাবার সেই ঘর আগুনে পুড়ে গেছে। শ্মশানযাত্রীদের কাছে খবর পেয়ে পুলিশ এসেছিল। ভিতরে পাওয়া গেছে আধপোড়া দুটো পুরোনো নরকঙ্কাল। আপনি তখন ওইভাবে পালিয়ে এলেন! কিছু দেখেছিলেন নাকি?’
উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু। রামেশ্বর অবশ্য থামল না। শহরে এমন হলে এতক্ষণে তোলপাড় হয়ে যেত স্যার। আপনাকে সেদিন সব বলিনি। গোড়ায় রাতের দিকে শ্মশানে মড়া পোড়াতে গিয়ে অনেকেই দুটো আস্ত নরকঙ্কালকে হেঁটে বেড়াতে দেখেছে। সেই থেকে কেউ আর রাতে মড়া নিয়ে যেত না। সবাই বলত ওনারা নাকি ভূত–প্রেত নিয়ে বাস করতেন। যেমন এসেছিলেন তেমন হঠাৎই ঘরে আগুন দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছেন হয়তো।রামেশ্বর থামল। তারপর সামান্য ভেবে স্বগতোক্তির মতো বললআর–একটা অদ্ভুত ব্যাপার স্যার। দুজন থাকতেনঅথচ বাইরে ওনাদের একসাথে কখনো দেখা যায়নিসেও এক রহস্য। অনেকেই তা নিয়ে নানা কথা বলত।
রামেশ্বরের সঙ্গে ব্যাপারটা নিয়ে আর কথা বলিনি। পরে থানায় ফোন করে জানলাম আধপোড়া নরকঙ্কাল দুটির একটি পূর্ণবয়স্ক পুরুষ। অন্যটি পূর্ণবয়স্ক মহিলার।
পরের দিন সোজা ডি.এস.পি অফিসে। পদমর্যাদার কারণে ভদ্রলোকের সঙ্গে আগেই পরিচয় ছিল। দেখা করে একে–একে সবই খুলে বললাম তাঁকে। আমার সেই প্রচেষ্টায় কিছু কাজ হয়েছিল এরপর। নরকঙ্কাল দুটো বস্তায় ভরে ফেলে রাখা হয়েছিল থানায়।   হয়তো দু–এক দিনের মধ্যে নষ্ট করে ফেলা হত। কিন্তু ব্যবস্থা নিয়ে সেগুলি এরপর পাঠানো হয়েছিল কলকাতায় ফোরেনসিক ল্যাবে। পরীক্ষায় দেখা গিয়েছিল দুটি মানুষের মৃত্যুই অনাহারজনিত কারণেডি.এন.এ টেস্টে প্রমাণিত হয়েছিল পুরুষ কঙ্কালটি অনুতোষের। কিছু সমস্যা হয়েছিল স্ত্রী কঙ্কালটিকে নিয়ে। চন্দ্রা বৈষ্ণব পরিবারের মেয়ে বাড়ি নবদ্বীপে—এটুকুই শুধু জানা ছিল। তবে শেষ পর্যন্ত পরিবারটিকে খুঁজে বের করা গিয়েছিল। ডি.এন.এ টেস্টে এক্ষেত্রেও প্রমাণিত হয়েছিল সেটি চন্দ্রারই। দুটি কঙ্কালই অন্তত কুড়ি বছরের পুরোনো।
পুলিশের সেই কেস ডায়েরি বিন্দুমাত্র এগোয়নি তারপর। তেমন কোনও ব্যাখ্যা আমার কাছেও নেই। আগের দু–দিন ভৈরবী চন্দ্রার পুরুষালি গলার আওয়াজ আচার–আচরণ কিছু অস্বাভাবিক লাগলেও অনুতোষকে কখনই তেমন মনে হয়নি। ও নিজেও বলেছিল মহাবজ্রতন্ত্রমে সিদ্ধিলাভ করতে পারলে শুধু অসীম ক্ষমতাই নয় ইচ্ছামৃত্যুর অধিকারী হওয়া যায়। একই কথা ভৈরবী চন্দ্রাকেও বলতে শুনেছি। অথচ পরীক্ষায় প্রমাণিত বছর কুড়ির পুরোনো পুরুষ কঙ্কালটি তারই। তবে কী তন্ত্রসিদ্ধ মানুষটি নিজের অন্যায়ের মাশুল এভাবেই মিটিয়ে দিয়ে গেল?
ছবি: প্রকাশ গুপ্ত
আপলোড: ৬/১/২০১৯

19 comments:

  1. গায়ে কাঁটা দেয়...

    ReplyDelete
  2. খুব ভালো লাগলো 👌

    ReplyDelete
  3. গায়ে কাঁটা দিল

    ReplyDelete
  4. Onekta taranath tantriker kotha mone koriye dilo.ga chhomchhom kore ritimoto.

    ReplyDelete
  5. Onekta taranath tantrik k mone koray.

    ReplyDelete
  6. দারুণ লাগলো

    ReplyDelete
  7. অসাধারন আরো চাই

    ReplyDelete
  8. শিহরণ জাগানো...

    ReplyDelete
  9. Khub sundor lekha..ami ki apnar golpo ti audiostory kore porte pari? Apnar permission r jonno apekhay thakbo.

    ReplyDelete