Wednesday 2 January 2019

ভৌতিক হরর গল্প (মোবাইল ভাঃ): আতঙ্ক (শিশির বিশ্বাস)


আতঙ্ক
শিশির বিশ্বাস
ক্রমশ খালি হয়ে আসছে পাড়াটা। পশ এরিয়া এমনিতেই নিরিবিলি তার উপর গত মাস কয়েক ধরে এই এক অদ্ভুত ব্যাপার চলেছে। সবার চোখে–মুখে কেমন আতঙ্কের ছায়া। একে একে খালি হয়ে যাচ্ছে বাড়ি অনেক বাড়ির ফটকেই উর্দিধারী পাহারাদার ছিল তারা কাজ ছেড়ে আগেই চলে গেছে তবু আদিনাথবাবুরা ছিলেন মা অসুস্থ হবার পরে প্রায়ই খোঁজ নিতে আসতেন পরামর্শ দিতেন খুব ভরসা পেতাম তিনিও আজ সপরিবারে বাড়িতে তালা দিয়ে চলে গেলেন তাদেরও চোখে–মুখে সেই আতঙ্ক ট্রাক ভরতি কিছু মালপত্রও নিয়ে গেলেন তাড়াতাড়ি ফিরবেন মনে হয় না
আমার অবশ্য উপায় নেই। বিহারের অজ এক দেহাতি গ্রামের ছেলে। এসব নিয়ে কেউ সেখানে মাথা ঘামায় না। ভোর হলেই শুরু হয়ে যায় পেটের ভাবনা। সামান্য লেখাপড়াও শেখা হয়নি ওসবের চলও নেই সেখানে একটু বড় হলেই কোনও মনিবের ঠেকে কাজে লাগিয়ে দেওয়াই দস্তুর খেতি নয়তো মাঠে গরুমোষ চরাও
আমাকে অবশ্য সেই পর্যন্ত যেতে হয়নি বয়স পাঁচের কোঠায় পড়ার আগেই বাবামা হঠাৎ মারা যেতে গ্রামের কয়েকজন একদিন ইস্টিশনে নিয়ে কলকাতার এক ভিড়ে ঠাসা ট্রেনে তুলে দিলেন ওখানে এটাই দস্তুর শুধু অনাথ নয় কেউ পাগল হয়ে গেলেও তাকে কলকাতার ট্রেনে তুলে দিয়ে ঝামেলা মিটিয়ে ফেলে কলকাতার পথে কুড়িয়ে খেলেও প্রাণ বাঁচবে।
কোনোদিন গ্রামের বাইরে পা দেইনি ট্রেনে সারাটা সময় ভয়ে কাঠ হয়ে ছিলাম ভিড় গাড়িতে মানুষের জুতোয় ছড়ে রক্ত বের হয়েছে ভয়ানক যন্ত্রণা তবু গলা দিয়ে শব্দ বের হয়নি পরের দিন সকালের দিকে ট্রেন হাওড়া ইস্টিশনে পৌঁছোতে সবাই নামতে থাকল নেমে পড়লাম আমিও
তারপর ধীরে ধীরে অভিজ্ঞতা কম হয়নি এত বড় কলকাতা শহর কুড়িয়ে খেয়েও দিব্যি চলে যায়। বেশ মানিয়েও নিয়েছিলাম। দিনভর পথে পথে। শুধু শহর নয় আশপাশও বেশ চেনা হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কপালে সইল না একদিন পুলিশের খপ্পরে পড়ে গেলাম তারা এক অনাথ আশ্রমে জিম্মা করে দিয়ে গেল ফের সেই কষ্টের দিন পাঁচিলঘেরা উঁচু জেলখানার মতো বাড়ি গেটে পাহারাদার কিন্তু অন্য কিছুই নেই দিন গেলে যে খাবার মেলে তাতে পেট ভরে না বয়সে যারা ষণ্ডা তারা তাই অন্যদের খাবার কেড়ে খায় কিছু বলার ক্ষমতা নেই তার উপর হামেশাই চড়চাপড় শুধু ষণ্ডা ছেলেদের নয় হোমের বাবুদেরও তাদের হরেক ফাইফরমাশ খাটতে হয় এদিকে পেটে খিদের তাণ্ডব
এভাবে আর কিছুদিন চললে মরেই যেতাম হয়তো চোখের সামনে অনেককেই মরতে দেখেছি একটু পরে গাড়ি এসে লাশ নিয়ে চলে যেত কিন্তু আমার বেলা কিছু অন্য রকম হয়ে গেল একদিন হোমের এক সর্দারবাবু আমাকে চানের ঘরে গিয়ে সাবান মেখে চান করতে বললেন তারপর পরিষ্কার জামাপ্যান্ট পরিয়ে নিয়ে গেলেন অফিস ঘরে সেখানে তখন হোমের মালিকও বসে এছাড়া বয়স্ক এক মহিলা পরনে সাদা হলেও রঙিন পাড়ের দামী শাড়ী রানিমায়ের মতো অমন ঝকঝকে দামী শাড়ি জামাকাপড় আমাদের গ্রামে মনিবের বাড়ির কাউকেও পরতে দেখিনি ভয়ে কাঠ হয়ে আছি উনি কাছে ডেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন
মুহূর্তে আমার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে নামল  উনি রুমাল বের করে মুছিয়ে দিলেন একটু পরে বেরিয়ে পড়লেন আমাকে নিয়ে বাইরে ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল উঠে বসলেন তাতে
এ পর্যন্ত একটি কথাও মুখ থেকে সরেনি ঘটনার আকস্মিকতায় প্রায় হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম গাড়ি চলতে শুরু করতে চমকে উঠে বললামরানিমাঈ কোথায় যাচ্ছি?’
উনি অল্প হাসলেন ফের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেনআমি রানি নইরে পাগলা তোর নতুন মা তোকে অ্যাডপ্ট নিয়েছি মা বলে ডাকবি
রানিমার সেই কথার অর্থ সেভাবে বুঝতে না পারলেও যেটুকু বুঝলাম তাতে অবাক হয়ে বললামতুমি তুমি মাঈ!’
মাঈ নয় রে পাগলাউনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন আবারমা মা বলবি আমাকে মনে থাকবে
আমি মস্ত করে ঘাড় নেড়েছিলাম শুধু
পাঁচিল ঘেরা অনেকটা জমি নিয়ে নতুন মায়ের বাড়ি ঝকঝকে প্রতিটি ঘর জনা কয়েক কাজের মানুষ জানলায় দামি পর্দা এমন বাড়িতে কোনও দিন যে ঠাঁই হবে স্বপ্নেও ভাবিনি গোড়ায় কয়েক দিন তো মাঝেমধ্যেই মনে হত বুঝি স্বপ্ন দেখছি ভেঙে গেলেই দেখব সেই হোমের জেলখানায় পড়ে আছি
নতুন পরিবেশে নতুন আদবকায়দা কী সহজে রপ্ত হতে চায়? প্রায়ই ভুল হয়ে যেত বাড়ির কাজের মানুষও হাসত নতুন মা কিন্তু কখনই বিরক্ত হতেন না ভুল হয়ে গেলে হাতে ধরে বুঝিয়ে দিতেন বলতেন তোকে আমি মিঠুনের থেকেও বড় করে তুলব পারবি না?
ততদিনে সামান্য হলেও বুঝতে শিখেছি প্রথম দিন মার মুখে ওই নাম শুনে থতমত খেয়ে বলে ফেলেছিলামমিঠুন মিঠুন কে মা?’
আমার কথায় মা নিজেও কিছু অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলেন তবে সামলে নিয়েছিলেন মুহূর্তেইমিঠুন? সে ছিল একজন এখন কেউ না
ততক্ষণে আমার দৃষ্টি এড়ায়নি মায়ের চোখ দুটো ছলছল হয়ে উঠেছে এখনই গড়িয়ে পড়বে হয়তো আমি অপ্রস্তুত হয়ে বললামতুমি তুমি কাঁদছ মা!’
ঠোঁট কামড়ে সামান্য দম নিলেন উনি চোখের কোলে তখন ছিটেফোঁটা জলও অবশিষ্ট নেই দেখলাম একদম স্বাভাবিক গলায় বললেনভেবেছিলাম ওর জন্য আর কাঁদব না তবু দ্যাখ চলে আসে কান্না কী জানিস যখন বিধবা হলাম মাত্র চার বছর বয়স ওর নিজের মতো করে বড় করেছিলাম মিঠুন লেখাপড়ায় বড্ড ভাল ছিল রে তারপর চাকরি পেল নিজে পছন্দ করে বিয়ে করল ওর ইচ্ছায় কিছুমাত্র বাধা দিইনি আমি তবু আলাদা বাসা নিয়ে চলে গেল তুইও তাই করবি বুঝি?’
আমি জড়িয়ে ধরেছিলাম মাকেঅমন কথা বোলো না মা যদি তাড়িয়ে না দাও চিরকাল তোমার কাছে থাকব কোত্থাও যাব না
সে মিঠুনও বলতো রেবলতে গিয়ে মা হেসে ফেলেছিলেন বড়ো করুণ হাসি তারপর কাছে টেনে মাথায় হাত বুলিয়ে কান্নাভেজা গলায় বলেছিলেনকী জানিস বাবা উনি যা রেখে গিয়েছেন যা পেনসন পাওয়া যায় অভাব নেই তবু তো কাউকে দরকার দুটো কথা বলার জন্যও তো কাউকে লাগে বল?’
উত্তরে কিছুই বলতে পারিনি তবে সেই দিনই ঠিক করে ফেলেছিলাম মায়ের কোনও কষ্ট রাখব না কিন্তু ভাবলেই কী সব হয় একে ছেলেমানুষ পেটে তেমন বিদ্যেও নেই মা অবশ্য শুরু করে দিয়েছিলেন ঘরে বসেই অক্ষরজ্ঞান চটপট শিখেও ফেলেছিলাম মাসের মধ্যে বাংলা বেশ পড়তে শিখেছি আর কিছু সড়গড় হলেই ইংরেজি আর অঙ্ক শুরু হবে তার মধ্যেই এক ব্যাপার হয়ে গেল
সেদিন বিকেলে মায়ের কাছে পড়তে বসেছি দামি পোশাক পরা এক ভদ্রলোক এলেন গোড়ায় মা যথেষ্ট ভদ্র ব্যবহারই করেছিলেন ড্রইংরুমেও বসিয়েছিলেন আমি অন্য ঘরে একাই পড়ছিলাম হঠাৎ তর্কাতর্কির শব্দে ছুটে গিয়ে দেখি মা ক্ষোভে প্রায় ফেটে পড়েছেনহরনাথবাবু কতবার আপনাকে বলেছি না স্বামীর এই বাড়ি আমি প্রমোটারকে দেব না যেমন আছে তেমনই থাকবে তবু কেন এসে বিরক্ত করেন? শিগগির চলে যান
একটুও উত্তেজিত না হয়ে অন্য পক্ষ কিছু বোঝাবার চেষ্টা করছিলেন কিন্তু মা একটি কথাও শুনতে চাইলেন না হঠাৎ চিৎকার করে উঠলেনইউ ম্যান গেট আউট আর যেন এই বাড়িতে না দেখি
মায়ের সেই কথায় ভদ্রলোকের মুখ হঠাৎ কেমন হিংস্র হয়ে উঠল আমার ভয় হচ্ছিল লোকটা ভয়ানক কিছু করে ফেলবে হয়তো বাড়িতে কাজের মানুষও কেউ তখন নেই বেশ ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম মার কিন্তু কোনও দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই সমানে চিৎকার করে চলেছেনইউ গেট আউট ইউ গেট আউট ম্যান এখুনি
মায়ের এই রুদ্র মূর্তি কখনও দেখিনি ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন শেষ পর্যন্ত দাঁত কড়মড় করে এক ঝলক মায়ের দিকে তারপর আমার দিকে তাকালেন শেষে জুতোর মসমস আওয়াজে বের হয়ে গেলেন ক্ষোভে উত্তেজনায় মা তখন থরথর করে কাঁপছেন
সেদিন ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল মা নিজেই ফোন করেছিলেন খুব অসহায় লাগছিল লেখাপড়া জানলে অন্তত ডাক্তারের নম্বরটা খুঁজে ফোনটা করতে পারতাম মাকে কষ্ট করতে হত না
মা সেবার শয্যাশায়ী ছিলেন বেশ কয়েকদিন সব সময়ের জন্য নার্স দুএক দিন অন্তর ডাক্তার মুখে বলতে পারিনি কিছুই কিন্তু মায়ের ওই অবস্থা দেখে বুকের ভিতরটা ফেটে যেত কী বোকা আমি! ভাবতাম মা খুব সুখী মানুষ কিন্তু ভিতরে এত অশান্তি কষ্ট ভাবতেও পারিনি মা আমার অবস্থা কিছুটা অনুমান করতে পেরেছিলেন কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠতে নিজেই একদিন বললেনতুই মন খারাপ করিসনে ভদ্রলোকের এই বায়না চলছে উনি মারা যাবার পর থেকেই এখানে ফ্ল্যাটবাড়ি তুলতে চায় মিঠুন তখন মাত্র চার বছরের আর এখন তো এখানে জমির দাম আকাশ ছুঁয়ে ফেলেছে লোভ তো হবেই তার উপর মিঠুনকেও সঙ্গে পেয়ে গেছে মিঠুন আর বৌমা দুজনেরই ইচ্ছে এখানে ফ্ল্যাটবাড়িই হোক কয়েক বার নানাভাবে বোঝাতেও এসেছিল এতটা জমি এই বাজারে এভাবে ফেলে রেখে কী হবে! বরং ফ্ল্যাট বাড়ি উঠলে অনেক লাভ প্রমোটার হরনাথবাবু দুই আর তিন তলায় দুটো করে সেরা ফ্ল্যাট দেবেন সঙ্গে নগদ মোটা টাকা কিন্তু আমাকে নড়াতে পারেনি
ওরা হয়তো খুব ভুল বলেনিঅনেকটা সময় কথা বলে মা হাঁপিয়ে উঠেছিলেন সামান্য বিরতি দিয়ে বললেনকিন্তু কীভাবে ধারদেনা করে মিঠুনের বাবা বাড়িটা তৈরি করেছিলেন সে তো জানি সেই ধার শোধ দিতে কম কষ্ট তো হয়নি! তবু পরোয়া করেননি বারান্দার রেলিং আমার তেমন পছন্দ হচ্ছিল না ফের ভেঙে তৈরি করেছিলেন কত ইচ্ছে ছিল কত কিছু বলতেন সেই বাড়ি আমি বেঁচে থাকতে ভেঙে ফেলবে ওরা!’ বলতে বলতে বুকে হাত দিয়ে ফের থেমে গিয়েছিলেন মা
সেদিনের পর ব্যাপারটা নিয়ে মাকে আর কথা বলতে দিইনি আমি প্রসঙ্গ তুললেই চুপ করিয়ে দিতামওসব থাক মা আগে তুমি পুরো সুস্থ হয়ে ওঠো
কিন্তু সামান্য পথের ছেলে আমি সেই ভাবনার কতটুকুই বা মূল্য মা তখনও সারাদিন বিছানায় একদিন এক ভদ্রলোক বাড়িতে এলেন একদম মায়ের মুখের আদল বাড়িতে মিঠুনদাদার কোনও ছবি নেই তবু সেই মুখের দিকে তাকিয়ে মায়ের একমাত্র ছেলেকে চিনতে ভুল হয়নি সঙ্গে একজন সুন্দরী মহিলা স্ত্রীকে নিয়ে মাকে দেখতে এসেছেন উনি খুব আনন্দ হয়েছিল ভেবেছিলাম মায়ের এই অবস্থা দুই পক্ষের মিল হয়ে যাবে এবার
কিন্তু আমার ভাবনা কিছুমাত্র মেলেনি পাশের ঘরেই ছিলাম প্রাথমিক দুএক কথার পরেই মিঠুনদাদা হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটে বললেনতুমি তুমি অরফ্যান হোম থেকে অ্যাডপ্ট নিয়েছ মা!’
নিয়েছি তোমা চেঁচিয়ে উঠলেন হঠাৎশুধু অ্যাডপ্ট নয় হাইকোর্টের বড় অ্যাডভোকেটের সঙ্গে কথাও বলেছি সব দিয়ে যাব ওকে ভেবেছিলি আমি বিদেয় হলে….মা কথা শেষ করতে পারলেন না বুকে হাত দিয়ে ভয়ানক কাশতে শুরু করলেন নার্স ব্যস্ত হয়ে পড়লেন তাঁকে নিয়ে ছুটে এলাম আমিও মিঠুনদাদা আর তাঁর স্ত্রী তখনও প্রায় নির্বিকার দেখে আমি তাঁদের হাত জোড় করে পাশের ঘরে বসতে বলেছিলাম উত্তরে মিঠুনদাদা দুই চোখে আগুন ছুঁড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেনসাট আপ ইউ সোয়াইনতারপর স্ত্রীকে নিয়ে গটমট করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন আমি কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ভীষণ অপরাধী মনে হচ্ছিল নিজেকে হাজার হোক উনি মায়ের নিজের ছেলে আমার কথা বলা ঠিক হয়নি
অপরাধবোধটা সমানে কুরে খাচ্ছিল রাতের দিকে মা সামান্য সুস্থ বোধ করতে কাছে গিয়ে বললামআমার ভুল হয়ে গেছে মা মিঠুনদাদাকে ওইভাবে বলা উচিত হয়নি
মা আমার মাথায় হাত রেখে বললেনওরে কিচ্ছু ভুল করিসনি তুই শুধু কথা দে আমায় ছেড়ে যাবি না
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল মা নার্সের ইঙ্গিতে আমি বেশিক্ষণ আর থাকিনি শুধু বলেছিলামতুমি ভেবো না মা তোমায় কোনও দিন ছেড়ে যাব না আমি
মার অসুস্থতা ক্রমে বেড়েই চলল এরপর দিনরাত নার্স বড় ডাক্তার কিছুই বাদ ছিল না কিন্তু তেমন কোনও উন্নতি দেখা যাচ্ছিল না সারাদিন প্রায় শুয়েই থাকেন চলছিল এই ভাবেই তার মধ্যেই একদিন কিছু বেলার দিকে মিঠুনদাদা দেখা করতে এলেন খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম মায়ের যা অবস্থা ফের না একটা অঘটন হয় কিন্তু মিঠুনদাদা এবার তেমন কোনও প্রসঙ্গ তুললেন না জানালেন তাঁর বাসার কাছে চেন্নাই থেকে বড় এক হার্ট স্পেশালিষ্ট এসেছেন উনি তাঁর সঙ্গে মায়ের ব্যাপারে কথা বলেছেন দেখতে রাজিও হয়েছেন তিনি আজই ভিজিটিং ডেট সেই জন্যই তাঁর আসা মাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়ে আনবেন
ভেবেছিলাম মা হয়তো রাজি হবেন না কিন্তু আশঙ্কা অমূলক করে মা বললেনতা নিয়ে আয় না তাঁকে ভিজিট নিয়ে ভাবতে হবে না। যা লাগে দেব
মিঠুনদাদা বললেনসে কথা আমিও বলেছিলাম মা উনি রাজি হলেন না আসলে কলকাতায় এলে উনি বাড়িতে গিয়ে পেশেন্ট দেখেন না তবে কথা দিয়েছেন বসিয়ে রাখবেন না গেলে তৎক্ষণাৎ দেখে দেবেন দেড়দুই ঘণ্টার মধ্যে ফিরে আসতে পারবে
মা তবু রাজি হচ্ছিলেন না ডাক্তারের নাম শুনে নার্স কিন্তু দেখিয়ে আসতেই মত দিলেন আমিও তাই বললাম শেষ পর্যন্ত রাজি হলেন মা অ্যাম্বুলেন্স আনা হয়েছিল মা সেই অ্যাম্বুলেন্সে নার্সকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলেন
মিঠুনদাদা ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যে ফিরে আসবেন বলেছিলেন কিন্তু প্রায় সন্ধে হতে চলল কারও দেখা নেই তখনও ভীষণ দুশ্চিন্তায় ঘরবার করছি রাত প্রায় আটটা নাগাদ একটা গাড়ি বাড়ির সামনে এসে থামল ছুটে বের হয়েছি মিঠুনদাদা ঢুকলেন একাই আমি রুদ্ধশ্বাসে বললামমিঠুনদাদা মা কোথায়?’
উনি সামান্য উদ্বেগভরা গলায় বললেনডাক্তারের পরামর্শে মাকে আজকের মতো আমার বাসায় নিয়ে তুলেছি শুধু খবর দিতে নয় তোকে নিয়ে যেতেও এসেছি মা তোকে কিছু বলবেন বোধ হয় বার বার বলছেন তাই ছুটে এলাম
আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললামকিন্তু মা যে না ফেরা পর্যন্ত আমাকে বাড়িতেই থাকতে বলে গেছেন!’
বোকার মতো কথা বলিসনিমিঠুনদাদা ঘাড় ঝাঁকালেনমাই তোকে ডেকেছেন না যেতে চাস তো ফিরে গিয়ে সেই কথাই বলি
এরপর মিঠুনদাদার কথায় রাজি না হয়ে উপায় ছিল না গাড়িতে রওনা হয়ে পড়েছিলাম ওনার সঙ্গে
এই কলকাতা শহরের পথে পথে ঘুরে বেড়িয়েছি দিনের পর দিন অনেক কিছুই চেনা ভবানীপুরে জগুবাজারের কাছে এসে গাড়িটা যখন থামল চিনতে অসুবিধা হয়নি মায়ের কাছে শুনেছি মিঠুনদাদা ভবানীপুরের দিকে বাসা নিয়ে থাকেন নামার জন্য তৈরি হচ্ছি মিঠুনদাদা বললেন তুই গাড়িতে একটু বোস আমি বাজার থেকে সামান্য কেনাকাটা করে আসছি
চলে গেলেন উনি ফিরে এলেন মিনিট কয়েকের মধ্যেই হাতে ছোট এক প্যাকেট সেটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেনএতে প্যাটিস আর জলের পাউচ আছে তুই খেয়ে নে সারাদিন কিছুই বোধ হয় খাসনি আমি ততক্ষণে বাজার করে আসছিআমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে চলে গেলেন উনি
মিঠুনদাদা ভুল বলেননি বাড়িতে খাবার থাকলেও মায়ের চিন্তায় সারাদিন প্রায় কিছুই খাওয়া হয়নি খেয়াল হল ভীষণ খিদেই শুধু নয় জল তৃষ্ণাও পেয়েছে
প্যাকেটের সেই প্যাটিস আর জল খেয়ে ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম বোধ হয় মিঠুনদাদাও ফিরতে দেরি করছিলেন গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল যথাস্থানেই
সেই ঘুম যখন ভাঙল চারপাশে তাকিয়ে প্রায় চমকে উঠলাম অন্ধকারে এ কোথায় পড়ে আছি আমি! কতক্ষণ! প্রায় ধড়মড়িয়ে উঠলাম নিশুতি গভীর রাত তবু চারপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম জায়গাটা ধাপার কাছে ভেড়ি অঞ্চল কাছেই পাঁকে ভরা পোড়ো এক খাল আকাশ পাতাল ভাবছি মাথা কিছু সাফ হতেই মনে পড়ল মায়ের কথা লাফিয়ে উঠেই ছুটলাম কলকাতায় বাড়ির দিকে
ধাপার এদিকে আগেও এসেছি তবু পথ চিনে ফিরতে সকাল হয়ে গেল বাড়ির সদর গেট বাইরে থেকে তালা লাগানো কিন্তু বের হবার সময় যে তালা আমি লাগিয়ে গিয়েছিলাম এটা সেই তালা নয় পুরনো তালার চাবি পকেটে ছিল হাতড়ে সেটাও পেলাম না অগত্যা পাঁচিল টপকেই ঢুকে পড়লাম ভিতরে বাড়ির দরজা বন্ধ ভিতরে কেউ নেই
বুঝতে পারছিলাম মা এখনও ফেরেনি নার্সও আসেনি দেরি না করে ছুটলাম ভবানীপুরের দিকে মিঠুনদাদার বাড়ি চেনা হয়নি কিন্তু ওখানেই যখন থাকেন ঠিক খুঁজে বের করতে পারব
কাজটা যত সহজ ভেবেছিলাম তেমন হয়নি দুটো দিন শুধু পথেই ঘুরে বেড়ালাম তারপর হঠাৎ এক দুপুরে দেখি বউদিদিমণি বাজার থেকে ফিরছেন পিছু নিলাম একবার ভেবেছিলাম কাছে যাই কিন্তু আগের দিনের কথা ভেবে সাহস হল না
বাসা বেশি দূরে নয় বড় দালানবাড়ির তিনতলায় এক ফ্ল্যাট বউদিদিমণি দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন পিছনে আমিও প্রায় নিঃশব্দে ঢুকে পড়লাম হঠাৎ গিয়ে অবাক করে দেব মাকে সেই ইচ্ছে
তিন কামরার ছোট ফ্ল্যাট একের পর এক ঘর ঘোরা হয়ে গেল কিন্তু মা কোথায়? কোনও ঘরেই দেখতে পেলাম না তাঁকে বাসায় মিঠুনদাদাও নেই বউদিদিমণি ইতিমধ্যে কিচেনে কিছু করছিলেন আমি সামনে গিয়ে বললামবউদিদিমণি আমার মা কোথায়? তাঁকে দেখছি না যে!’
উত্তরে বউদিদিমণি আমার দিকে এক পলক তাকালেন তারপর আতঙ্কে ছুটে বেরলেন বাইরে সঙ্গে ভয়ার্ত কণ্ঠে চিৎকার তাঁর সেই চিৎকারে আশপাশ থেকে কয়েকজন ছুটে এলেন ব্যাপার দেখে নিজেই এবার ভয় পেয়ে গেলাম চোর সন্দেহে হয়তো মারতে শুরু করবে ছুটে পালিয়ে এলাম সোজা আবার বাড়িতে মায়ের অপেক্ষায় সেই থেকে বাড়িতেই আছি
মা ফিরে আসেনি আর মিঠুনদাদারাও কেউ নয় তবে দিন কয়েক পরে অন্য একটা ব্যাপার হয়েছে ভয়ানক ব্যাপার সেদিন কিছু বেলার দিকে বাইরে গেটের তালা খোলার শব্দে বের হয়ে দেখি প্রমোটার হরনাথবাবু পিছনে ছেনিহাতুড়ি নিয়ে এক দঙ্গল কুলিমিস্ত্রি কী সাহস লোকটার! মা বাড়িতে নেই সেই সুযোগে মিস্ত্রিমজুর নিয়ে বাড়ি ভাঙতে এসেছে! হঠাৎ ভীষণ ভয় করতে লাগল বয়স্ক হলেও শক্তপোক্ত চেহারা সঙ্গে অত মানুষ তবু ছুটে গেলাম
হরনাথবাবু মিস্ত্রিদের কিছু বলছিলেন আমি সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলেন। মানুষটির বিষ্ফারিত দুই চোখে শুধুই আতঙ্ক। দেখে আমিও এগিয়ে গেলাম ভদ্রলোক এবার দ্রুত গেট পার হয়ে রাস্তা দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটতে শুরু করলেন ততক্ষণে সাহস কিছু বেড়েছে। আমিও ছুটলাম পিছনে তাই দেখে তিনি আরও জোরে ছুটতে শুরু করলেন বড় রাস্তায় পড়েও লোকটা উদভ্রান্তের মতো ছুটছিলেন উলটো দিকে থেকে যে তীব্র গতিতে বড় একটা ট্রাক আসছে হুঁশ ছিল না পড়ে গেলেন সামনে ট্রাকের ড্রাইভার ব্রেক চেপেছিলেন কিন্তু বড় গাড়ি থামতে থামতেই হরনাথবাবুকে পিষে দিয়ে গেল মুহূর্তে মৃত্যু
একের পর এক এমন অদ্ভুত ব্যাপার কেন যে ঘটছে আজও বুঝে উঠতে পারিনি তবে মায়ের এই বাড়ি ভাঙতে তারপর কেউ আর আসেনি তবু সতর্ক হয়ে থাকি শুধু দিনেই নয় রাতেও ঘুরে বেড়াই বাড়ির চারপাশে। টহল দিয়ে বেড়াই। বলা তো যায় না। ইদানীং দেখছি পথেও মানুষ কমে আসছে সন্ধের পরে তো দেখাই যায় না আর আশপাশের বাড়ি খালি করে মানুষ তো আগেই চলে যেতে শুরু করেছে প্রতিবেশী বলতে একমাত্র আদিনাথবাবুরাই ছিলেন আজ তাঁরাও ঘর তালাবন্ধ করে চলে গেলেন
আমি অবশ্য সেই থেকে বাড়িতেই মা কবে ফিরে আসবেন সেই অপেক্ষায় আছি তাঁকে কথা দিয়েছিলাম যে।
আপলোড: ২০/৩/২০১৯

11 comments:

  1. খুব ভালো লাগলো। আজকের সমাজে এরকম যে কত ঘটছে।

    ReplyDelete
  2. আপনার লেখা আর blog দুটোই দারুন।

    ReplyDelete
  3. সকালে একবার পড়েছিলাম, এখন এই রাত্রেই আরেকবার পড়ে ফেললাম। ছোট্ট ছোট্ট ছবি দিয়ে তৈরী জমাট একটা composition. ঠিক যেন সদ্য শাণ দেওয়া ছুরির মতো ঝকঝকে একটা গল্প!

    ReplyDelete
  4. খুব ভালো লাগল।

    ReplyDelete
  5. খূব ভালো লাগলো

    ReplyDelete
  6. ভালো কিন্তু পড়ে একটু মনটা খারাপ হয়ে গেলো! 🙁

    ReplyDelete